• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ঐতিহ্যবাহী লেবানন

সংগৃহীত ছবি

সাহিত্য

ঐতিহ্যবাহী লেবানন

  • সুমন আহমেদ
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০১৯

ভ্রমণ কার না ভালো লাগে। অজানাকে জানার— নতুন নতুন জনপদ, তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখার আনন্দই আলাদা। হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম লেবানন ভ্রমণে যাব। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সীমান্তবর্তী। আমার এক দূরসম্পর্কের বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে থাকেন লেবাননে। নাম আবদুল মান্নান। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে শুরু হয় আমার লেবানন ভ্রমণ। এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে আসেন মান্নান ভাই। মান্নান ভাই থাকেন তারাবোলুস, এটি লেবাননের একটি শহর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার একটি প্লাস্টিকের ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। মান্নান ভাইসহ পাঁচজন বাঙালি কাজ করেন সেখানে, তারা হলেন— আল-মামুন, ইমন, রকিবুল ইসলাম ও আসাদুল ইসলাম। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওনাদের প্রতি মাসের বেতন ৪০০ ডলার বাংলাদেশের প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। থাকা মালিকের এবং খাওয়া ও পকেট খরচসহ যাবতীয় নিজেদের। প্রতি বছর বছর নিজ খরচে আকামা করতে হয়। আকামা খরচ ২ হাজার ডলার যা বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আরো জানতে পারলাম এখানে বাংলাদেশি মেয়েরা বাংলাদেশি ছেলেদের সঙ্গে কন্ট্রাক্টে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়। যতদিন এই দেশে থাকবে ততদিনই স্বামী-স্ত্রী এবং প্রতিনিয়ত অসংখ্য বাঙালি মেয়ে দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়।


পরেরদিন মান্নান ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম বরফঢাকা পাহাড়ময় অপরূপ লেবানন পরিদর্শনে। যত দেখছি দৃষ্টি যেন আটকে যাচ্ছে স্মৃতির ফ্রেমে...। উত্তরে সিরিয়া, দক্ষিণে ফিলিস্তিন, মেডেটিরিয়ান সাগরের পাড়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে অবস্থান করছে পাহাড়ময় লেবানন। তাদের সংস্কৃতি আরব্যদের মতোই। তারা আরবি ভাষায় কথা বলে, স্বাধীন চেতনায় তারা গণতান্ত্রিক। এদেশে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের বসবাস। এখানকার লেবানন আর আগের মতো নেই; নতুন রূপে রূপান্তরিত হয়েছে এই দেশ। নারী-পুরুষের কোনোরকম ভেদাভেদ নেই। পোশাক-আশাক দেখলে বোঝাই যায় না কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান। নামে কেবল মুসলিম, চালচলন পুরোটাই খ্রিস্টানদের মতো। প্রাচীনকালে নবী-রসুলদের পদচারণা ছিল এই লেবাননে। উঁচু উঁচু পাহাড়, সেই পাহাড়ের উপরে বিশাল বিশাল অট্টালিকা— সেই অট্টালিকায় জনবসতি। পাহাড়ের উপর দিয়েই বয়ে চলছে আঁকাবাঁকা, উঁচু-ঢালু পিচঢালা মেঠোপথ।

শীতের আরেক নাম লেবানন। শীতকালে প্রচণ্ড শীত, যাকে বলে হাড় কাঁপানো শীত। অবিরাম বৃষ্টিপাত— সঙ্গে শিলাবৃষ্টি, বরফঢাকা পাহাড়। আর গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রার অন্য এক লেবানন। এখনকার লেবাননের আয়তন ৪ হাজার ৩৬ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৬১ লাখ। লেবাননের রাজধানীর নাম বৈরুত। লেবাননে চলে ডলার, নতুবা লিরা। যদিও লেবানিজ পাউন্ড হলো তাদের জাতীয় মুদ্রা। প্রধান আয়ের খাত পর্যটন ও কৃষি। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি স্বাধীনতার স্বীকৃতি পায় ২২ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে। লেবাননের রূপকার হলেন রাফিক বা আল দিন হারিরি, যিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত রাফিক হারিরি নামে। রাফিক হারিরি মূলত ছিলেন একজন সৌদি ধনী ব্যবসায়ী। তিনি একজন সুন্নি সৎ মুসলিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৫ সালে ইসরাইলি চক্রান্তে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছিল এই বীর পুরুষ রাফিক হারিরিকে। লেবাননের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাফিক হারিরির সুযোগ্য সন্তান সাদ হারিরি।


স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় লেবাননের আকাশে উড়েছিল সুখের পায়রা। হঠাৎ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের চক্রান্তে একের পর এক শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে ইসরাইল হামলা চালালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। তারপর দেশটি বিরাট অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে যায়। ইসরাইলের চক্রান্তের শিকার এখনো পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলো। ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলিমদের ওপর একের পর এক নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এখনো সিরিয়ায় প্রতিদিন চলছে গৃহযুদ্ধ। বর্তমানে সিরিয়ার অসংখ্য মানুষ জীবন রক্ষার্থে অবস্থান করছে লেবাননে।

দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে এলো। এবার বিদায়ের পালা। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম স্মৃতিবিজড়িত দেশ লেবানন ছাড়তে তাই কষ্টই হচ্ছিল। যে সাধনায় যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের অক্লান্ত ঘাম ও অশ্রু ঝরিয়ে লেবাননকে গড়ে তোলা হয়েছিল, তা আজ স্মৃতিই মাত্র। যুদ্ধরত এই দেশটি আজ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। মান্নান ভাইসহ সবাইকে হাত উড়িয়ে বিদায় বার্তা জানাই। নাড়ির টানে রওনা দিলাম বাংলাদেশের উদ্দেশে। শুধু মনের গোপনে বর্তমান লেবানিজদের জন্য প্রার্থনার সুর উচ্চারিত হতে থাকে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে। ভালো থেকো লেবানন। ফিরে পাও তোমাদের লুপ্ত ঐতিহ্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads