• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
পৌষ সংক্রান্তির দেশ

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

পৌষ সংক্রান্তির দেশ

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। নানা ধর্ম-বর্ণের মিশেলে সংস্কৃতিতে এসেছে ভিন্নধারা। সেই আদিকাল থেকেই এই ধারা একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে আসছে। আতিথেয়তায় বাঙালির সুনাম বিশ্বজোড়া। আবার এই বাঙালি চিরকালই ভোজনরসিক। আর বাঙালির কাছে পিঠা মানেই শীতকাল। পিঠার কথা উঠতেই বাংলা মুলুকে পৌষ-মাঘের কথা চলে আসে। এ মাস বাঙালি নস্টালজিকতার মাস। সেই আদিকাল থেকেই বাংলার প্রতিটি ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায় শীত মৌসুমে। তখন চলে পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন। ধনী-গরিব প্রতিটি ঘরে ঘরে সাধ্যমতো পিঠা বানানোর তোড়জোড় চলে। হাজার বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এটা যতটা না খাওয়ার উৎসব তার থেকে বেশি বাংলার প্রাণের উৎসব।  

ঋতুর হিসেবে শীত মৌসুমে পিঠা তৈরির নানা রকমের গুড় বাজারে আসে। মিষ্টি খেজুরের রস থেকে খেজুরের গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়— এসব এ সময়েই পাওয়া যায়। গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারদিকে মৌ মৌ করে। এসব গুড় শীতকাল ছাড়া দেখা যায় না। তাই পিঠা তৈরির জন্য শীতকালই উপযুক্ত। তাছাড়া শীতের সকালের পিঠার স্বাদ অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে আলাদা। ঋতুর বৈচিত্র্যময়তা যে এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। তাই তো বাঙালি পিঠাপ্রিয়, সেই সঙ্গে অতিথিপ্রিয়ও বটে। 

পিঠার সঙ্গে পৌষ সংক্রান্তি শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা পুড়িয়ে (চিতই পিঠা বানানোর মাটির পাত্র) পিঠা তৈরি শুরু করে। অনেকেই আজো এই দিনের আগে পিঠা খান না। আর তাই এই সংক্রান্তি পিঠা উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৌষ সংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিনে এই উৎসব হয়ে থাকে। শেষের দিন হলেও সাধারণত দুই তিন দিন ধরে হরেক রকম পিঠা বানানোর কাজ চলে প্রতিটি হিন্দুবাড়িতেই। চলে জামাইকে নিমন্ত্রণ অথবা জামাইয়ের বাড়িতে তৈরি পিঠা পৌঁছে দেওয়ার পালা। একসময় গ্রামবাংলায় বেশ ঘটা করে এই দিন পালনের রেওয়াজ ছিল। তবে কালের বিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেসব রীতিনীতি। এই বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হতো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই বাজি ফুটানো, ফানুস ওড়ানো এসব আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে আনন্দমুখর এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটতো। পিঠা যে শুধু খাওয়া নয় বরং সবাই মিলে আনন্দ করার এক অনুষঙ্গ, সেটাও টের পাওয়া যায় এই উৎসব থেকে। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্য দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। জানা গেছে, প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। পৌষ সংক্রান্তিতে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়া, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। পৌষ সংক্রান্তির মাধ্যমে আমরা পৌষ মাসকে বিদায় জানাই ও মাঘ মাসকে আলিঙ্গন করি। সংক্রান্তির দিনে বাংলার বধূরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা ও সুস্বাদু পিঠা তৈরি করেন। পঞ্জিকা মতে, পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয় পৌষ মাসের শেষ দিন। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় এই দিন। বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য বিভিন্ন স্থানে এ দিবসটিতে কীর্তন, পালা গানেরও আয়োজন করা হয়ে থাকে।  

‘পিঠে’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পিষ্ঠক’ থেকেই এসেছে। পিঠে-পুলি খাওয়ার চল গ্রামবাংলার অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এমনভাবে মিশেছে যেন পিঠে নিজেই এক উৎসবের নাম। পিঠা আর আমরা বাঙালিকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। বাঙালি কতটা অতিথিপরায়ণ তা এই সময় বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। বাংলাদেশের বিশেষ কিছু পিঠের মধ্যে অন্যতম হলো— বিন্নি পিঠে, মালপোয়া পিঠে, সিমুই পিঠে, সূর্যমুখী পিঠে, ঝিনুক পিঠে, চিতই পিঠে, খেজুর পিঠে, বিনুনির মতন গড়া বেনি পিঠে, ঝালকুশ পিঠে, নকশা পিঠে, পাঁপড়ের আকারের মলকো পিঠে, করলা পিঠে, চঙ্গা পিঠে, মুঠা পিঠে ও রস চিতই পিঠে। পিঠা হলো আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। আমরা চাইলেও সে অংশকে আলাদা করতে পারব না। তবে শীতকাল এলে গ্রাম কি শহর— সর্বত্রই চিত্র পাল্টে যায়। পিঠা খাওয়ার ধুম ঠিকই পড়ে যায়। মিষ্টি পিঠার রসে শীতকালটা বাঙালির ভালোই কাটে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads