• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

আজব এক চিড়িয়াখানা

  • মীম মিজান
  • প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারি ২০১৯

আজ সোমবার। এপ্রিল মাসের শেষ সূর্যটির উদয় হয়েছে। গাজীপুর শহরের কাদাপানি আর ইব্রাহিমাবাদ স্টেশনের যাত্রী বিশ্রামাগারের কাদাপানি একই। তবে গাজীপুর শহরের ড্রেন খোঁড়াখুঁড়ি থেকে যে দলদলে মাটি রাস্তায় ছড়ানো তা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও পিচ্ছিল। বরকত সরণি থেকে লেগুনা করে জয়দেবপুর যাব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি চৌরাস্তা থেকে আসা লেগুনার জন্য। সকাল আটটার সময় ধান গবেষণা প্রগতি প্রাইমারি স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে। একজন মহিলা সঙ্গে দুটি মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়ে দুটির স্কুল ড্রেসের ব্যাচ থেকে বুঝতে পারলাম তারা ধান গবেষণা প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ডেইলি শপের সামনেই দাঁড়িয়ে আমরা। পূর্বমুখী একটি লেগুনা এসে দাঁড়াবে সামনে কিন্তু পেছনের বাসের ভেঁপু শুনে একটু সামনে গিয়ে রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। যেখানটায় দাঁড়ালো সেখানে সেই দলদলে মাটি ছড়িয়ে আছে। রাতের বর্ষণে পিচ্ছিল হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে মেয়ে দুটি উঠে পড়ল। যেই মহিলাটি উঠতে যাবে অমনি তার ফ্লাট চপ্পল পিচ্ছিল সেই কাদায় আটকে রাখতে পারল না তার ভরকে। ছপাত করে পড়ে গেল রাস্তায়। সদ্য সাজুগুজু করা চেহারাটা কী কদাকার হলো! আকাশি রঙের থ্রিপিস দলদলে কাদা লেপ্টে হয়ে গেল তামাটে। লেগুনার ড্রাইভারকে বকাবকি শুরু করল লেগুনাকে খানিক সামনে নিয়ে থামানোর জন্য। দু’হাতের ওপর ভর করে উঠতে সচেষ্ট হয় মহিলা। একটু কোমর সোজা হয়েছে। কিন্তু দলদলে সেই মহা পিচ্ছিল কাদা আবারো সেই মহিলার তামাটে লেপ্টানো শরীরটিকে ঝপাত করে বর্ণহীন ময়লার সমাহারে গড়িয়ে চলা ড্রেনে ফেলে দেয়। লেগুনার যাত্রীরা নেমে পড়ল হন্তদন্ত হয়ে। আমিও চপ্পল জোড়া খুলে দাঁড়ালাম ড্রেনের পাশে। কী ভয় পেয়েছে মহিলাটি! একগলা দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে সাহায্য করে তুলে আনলাম মহিলাকে। লজ্জায় মুখ লাল করে মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাসায় ফিরে গেল মহিলাটি।

জয়দেবপুর রেলস্টেশনে বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় আশপাশে কোনো জায়গায় বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন। তাই কম্পিউটার টিকিট সাপ্লাইও বন্ধ। ম্যানুয়াল টিকিট দিচ্ছে। লাইন এগোনোর কোনো নমুনা দেখলাম না। অনেকেই এসএমএস করে ট্রেনের অবস্থান জেনে নিয়ে বলাবলি করছে, আর তিন মিনিট বাকি আছে। ট্রেন তো চলেই আসবে। খানিক সময় পরেই ভেঁপু বাজিয়ে ট্রেন ঢুকে পড়ল প্লাটফর্মে। সাদা ও সবুজ রঙের সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রায় অর্ধেক টিকিটবিহীন যাত্রী উঠে পড়ল প্লাটফর্ম থেকে। ট্রেন একটু পরেই সশব্দে গতি বাড়িয়ে এগুতে থাকল উত্তর-পশ্চিম দিকে। ‘চ’ নম্বর বগিতে উঠে পড়েছিলাম আমি। টিকিটই পাইনি আবার সিটের চিন্তা! ব্যাগটি বাঙ্কারে রেখে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি।

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পরের দিন শবেবরাতের ছুটি। পরের দিন বৃহস্পতিবার ছুটি নিলে সরকারি ও ব্যাংক-চাকরিজীবীদের টানা পাঁচদিন ছুটি। তাই ট্রেনে যাত্রীর উপচেপড়া ভিড়। সিরাজগঞ্জের কয়েকটি পরিবার আজ একই সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে। তারা সবাই একে অপরের আত্মীয়। চৌদ্দজন যাত্রী তারা। ‘চ’ বগির ঠিক মাঝ বরাবর তাদের সিটগুলো। বগিটির মাঝে দুই দিকে দুটি ফিক্সড টেবিল আছে। এই টেবিলের একপাশে পরিবারগুলো। অন্যপাশে ছয়টি মেয়ে। এই মেয়েগুলোর বেশভূষা থেকে ঠাহর করা মুশকিল আসলে এদের পেশা কী? প্রায় সবাই লম্বা জামা পরেছে। জামাগুলো নতুন। এদের মধ্যে একজন চশমা পরেছে। তার চশমাটি মুখের কাঠামোর সঙ্গে একেবারেই বেমানান। দুজন স্কার্ফ পরেছে মাথায়। এখনকার ফ্যাশনেবল ছয়-সাত ভাঁজ করা মাথায়। দুজনের সিটে তিনজন বসেছে। হঠাৎই একজন স্কার্ফ খুলে আবারো মাথায় প্যাঁচানো শুরু করল। এতে যে তার উন্নত গঠন অন্যেরা দেখছে তাতে তার কোনো খেয়ালই নেই। তিন সিটের জানালার পাশে বেশ চটপটে একটি মেয়ে বসেছে। ট্রেনে উঠে সিটে বসার পর থেকেই নানা ভঙ্গিতে সেলফি তুলছিল। মুখে চুয়িংগাম অনবরত চিবোচ্ছে। মাঝে মাঝে মুখে বেলুন ফুলোচ্ছে সেই চুয়িংগাম দিয়ে। এই মেয়েটি বুকের একপাশে ওড়না দিয়েছে। অন্যপাশ খালি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই ছয়জনের টিমের লিডার। তিন সিটে চারজন বসিয়ে সেলফি তুলবে। অন্য তিনজন পোচ দিচ্ছে তবে তার পছন্দ হচ্ছে না। একটু দু’আঙুল উঁচিয়ে পোচ দিতে বলছে। মোবাইলটা জানালা দিয়ে বাইরে নেয়— এই সবাই তাকা। ট্রেনটা সজোরে ঝনাৎ করে উঠে পড়ে একটা ব্রিজে। কেঁপে উঠল বগিটি। অমনি হাত থেকে পড়ে যায় স্যামসাং মোবাইলটি। তড়িঘড়ি করে হাতটা ভিতরে নিয়ে হতভম্ব হয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘চেন টানো! চেন টানো! আমার মোবাইল পড়ে গেছে!’

পাশের লোকজন বলে, এই সাদা-সবুজ নতুন ট্রেনে চেন নেই। মেয়েটি তার পাশের মেয়েদের বলছে- সর, সর। আমি অ্যাটেনডেন্টকে বলে ট্রেন থামাবো। কিন্তু বগির করিডোরে যে পরিমাণ মানুষ দাঁড়িয়ে তাতে একজন মেয়েমানুষ হয়ে অ্যাটেনডেন্টের কাছে যাওয়া ও ম্যানেজ করে ট্রেন থামানো এক মহাযুদ্ধ করতে হবে। একজন বলল, বস! আর যাওয়া লাগবো না! সেলফি তোলার রোগ ধরেছে! এখন মোবাইলখানা তো পড়ে গেল! বিধ্বস্ত বদন নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল সেলফিকন্যা মিস চুয়িংগাম।

সিরাজগঞ্জগামী পরিবারের সেই চৌদ্দজনের দুজন মুরব্বি সরকারি অফিসের পদস্থ কর্মকর্তা হবেন। ভাবসাব দেখে মনে হয় অনেক টাকা কামান। একজন খানিকটা বেঁটে। তার পাশে বসা মহিলাকে দেখে মনে হলো তার বড় মেয়ের বয়সী। ফর্সা। স্মার্ট। চটপটে। আমি মোবাইল দেখতে দেখতে তার সিটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াই। বেঁটে কর্মকর্তা আমাকে ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন, ‘আঙ্কেল, তোমার আন্টির অসুবিধে হচ্ছে। অন্য কোনখানে দাঁড়াও।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লুম। এই বুড়োবেটার আন্টি এই সুঠাম আপা! হায় সেলুকাস!

বুড়ো-ইয়াং জুটির পেছনে বসেছে আরেক জুটি। তবে তাদের বয়সের কম্বিনেশন আছে। দুজনই বেশ ভারত্বের মানুষ। পেছনে বসা জুটির আঙ্কেলটি একটু খোঁচামেরে সামনের অসম জুটির বাইট্টা আঙ্কেলকে বলছেন, ‘এই হালা বিএনসিসির মেম্বার চা খাবা নাকি?’ ‘আহা! দুলাভাই এভাবে খোঁচা মারেন ক্যান? চা খাব।’ বলে উত্তর করেন।

রেল ক্যাটারার্স থেকে চা দেওয়া হলো। চৌদ্দজনের মধ্যে বিবাহিত ছয়জন নারী-পুরুষ। বাকি আটজনের মধ্যে সাতজন যুবক-যুবতী ও একজন শিশু। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। কোথায় কোথায় ঘুরবে? কী কী করবে? এই বচসা চলছে আর চায়ের কাপে চুমুক চলছে। হঠাৎই এক উঠতি বয়সী ছেলে তার নিজের সিট খোঁজার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে এগুচ্ছে। মাথায় একটি ব্যাগ। ডান হাতেও একটি ব্যাগ। এগোতে গিয়ে বেখেয়ালে ধাক্কা লাগে চা পানরত চৌদ্দজনের মধ্যে সাদা থ্রিপিস পরা করিডোরের কাছে বসা এক তরুণীর হাতে। অমনিই চায়ের কাপ উল্টে গোটা সাদা থ্রিপিস মেখে যায়। গরম চা গায়ে পড়ায় হাউমাউ করে চিৎকার করে ওঠে। বাইট্টা আঙ্কেল ক্ষেপে গিয়ে চপেটাঘাত করে উঠতি বয়সের ছেলেটির গালে। চপেটাঘাতের ঝোঁক সামলাতে না পারায় মাথার ব্যাগটি পড়ে যায় ইয়াং আন্টির কোলে। এবার তো আন্টির চায়ের কাপের চা দিয়ে প্রিন্টের থ্রিপিস মেখে যায়। তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বুড়ো বাইট্টার ওপর। নানা ধরনের কথা বলে ঝাড়ি মারতে থাকে। খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে সেই ইয়াং আন্টির কথাগুলো হজম করছেন বাইট্টা আঙ্কেল।

এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন সেতু পেরিয়ে কড্ডার মোড়ে নামতে যাবে সবাই, তখন ঝালমুড়িঅলা আসে করিডোর পার হতে। বাইট্টা আঙ্কেল ক্ষেপে আগুন। গলার স্বর উঁচু ভলিউমে দিয়ে ঝাড়তে লাগল, ‘এমনিতেই গোটা রাস্তা প্যারা নিয়ে এলাম। আর এখন তুই কোত্থেকে আসলি রে? সর! আগে নাইমা লই! জ্বালাইস না!’ ঝালমুড়িঅলার উত্তর, ‘আরে মিঞা বছরে আসেন তো একবারই। আর এভাবেই প্রত্যেক দিন ব্যবসা করে সংসার চালাই আমরা। আপনেগের মতো ঘুষ খাই না!’

ঘুষের কথা শুনে মাথাটা পুরাই গরম হয় বাইট্টা আঙ্কেলের। অগ্নিশর্মা চেহারা নিয়ে সামনে এগোয়। অন্য আত্মীয়রা থামাতে যাবে অমনিই চড় কষে দেয় ঝালমুড়িঅলার গালে। ঝালমুড়িঅলা তার পোঁটলা রেখে সপাং করে চড় কষিয়ে দেয় বাইট্টার গালে। বাইট্টা আঙ্কেল পুরোই ফ্রিজ হয়ে যায়। বাইরে তুমুল বর্ষণ। প্লাটফর্মে নেমে নিচুমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে অন্যান্য সবার সঙ্গে বাইট্টা আঙ্কেল। পৃথিবী নেতিয়ে পড়ছে ঝড়ো দমকা হাওয়া ও বর্ষণে। একজন ঝালমুড়িঅলার সপাং চপেটাঘাতেও বাইট্টা আঙ্কেল আত্মিকভাবে নেতিয়ে পড়েছেন। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads