• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

হাসান আজিজুল হক

আশিতে নট আউট

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালি মুসলমান গল্প লেখক বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় গল্প রচনা শুরু করেন চল্লিশের দশকে। তখনো প্রথাগত সংস্কার-আচার-মূল্যবোধকে তারা অতিক্রম করতে পারেনি। ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের আন্তঃদ্বন্দ্ব ক্রমশ বহুমাত্রিক; বিচিত্র হয়ে উঠেছে। শিল্পীআত্মার সঙ্গে সমাজনীতির দ্বন্দ্ব পরাভূত নয়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট গল্পকার হাসান আজিজুল হক (জ. ১৯৩৯)। তার গল্পে রাঢ়বঙ্গ-প্রকৃতি চমৎকার রেখাচিত্রে পরিবেশিত। প্রথম গ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন ও শীতের অরণ্য’ (১৯৬৪)-র ‘গুণীন’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’ এসবে রুক্ষ রাঢ় ও প্রতিরোধী প্রকৃতি প্রতিফলিত। লেখকের প্রকৃতির বর্ণনায় নিহিতার্থ জীবন বড় বঞ্চিত, দুর্বিষহ। গ্রামীণ পটে বিধৃত ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭), ‘জীবন ঘষে আগুন’ (১৯৮৫)-র গল্পগুলো। লেখকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগ্রন্থ নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৯), রোদে যাবো (১৯৯৫)। এছাড়া পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭) গল্পগ্রন্থের মধ্যেও নির্মম জীবনভাষ্য অঙ্কিত। হাসান আজিজুল হকের গল্প হওয়ার পথটি নির্মিত হয় বিপুল জীবনের মাহাত্ম্যে, কার্যকারণ সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। উঠে আসে যাবতীয় সংস্কার-কুসংস্কার, সংগ্রাম-প্রতিরোধের ছায়াচিত্র। তার উপমা-নির্বাচন কর্কশ, মর্মচিহ্নিত, তীক্ষধী। বর্ণনায় সামূহিক বাস্তবতা শ্রেণিস্তর অবলম্বী হয়ে ওঠে। তার সংলাপের দৃঢ়তা পরিলক্ষিত হয় শ্রেণিচেতনার মর্মে, রচিত পটরেখায় থাকে জীবনবাদী প্রণোদনা। অনুভূতির ছোঁয়ায় রাঢ় রক্তাম্বর অধ্যুষিত দিগন্তমেখলা সুন্দরের প্রতিমায় অঙ্কিত। মেধার সূচ্যগ্রে বন্দি ব্যক্তিচরিত্র। বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভেতরের প্রাণভোমরাকে স্পর্শ করেন লেখক। সেখানে রাষ্ট্রের শোষণ ও শ্রেণিচরিত্রের ভূমিকা, প্রান্তিক মানুষের প্রথাগত বিশ্বাস-সংস্কারে আঘাত হানেন— সে পরিহাসপ্রিয়তায় বঞ্চিত মানুষের অস্তিত্বের উচ্চারণই বড় হয়ে ওঠে। প্রতীকায়ণে ব্যক্তির সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের স্বরূপটি নির্বাচিত হয়। সাহিত্যে দেশ-সমাজ-ব্যক্তির দায়কে এভাবেই তুলে ধরেন তিনি। সেখানে গল্পের আবহটি ঘন রঙের, কথকের কথোপকথন প্রয়াসে চরিত্রানুগ বস্তুনিষ্ঠতায় কার্যকারণ প্রয়াসভিত্তি নির্মিত হয়। গল্পের নন্দনভূমে স্বপ্নাবিষ্ট, ধর্মভীরু আচ্ছন্ন মানুষের জীবনচরিত উন্মোচিত হয়। তখন ভাষার প্রকোপে বিদ্ধ হয় চরিত্র; তার প্রতিরোধ আর প্রতিকূলতায় উঠে আসে প্রবহমান সমাজ, জীবন লাভ করে অবমুক্তি। গল্পকারের গল্প তখন বিস্তৃতি পায় পাঠক পরিসীমায়। সেজন্য নিছক গল্প নয় বা গল্পরসে আপ্লুত করা নয়— গল্প বলার ভেতর দিয়ে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ও ব্যক্তির সংগ্রাম বা অবমুক্তির প্রক্ষেপণটি তুলে ধরেন। সেখানে হাসান আজিজুল হক আপসহীন। ভঙ্গিতেই গল্পের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চিত করেন তিনি। বাংলাদেশের সাহিত্যে অনবদ্য গল্পকার হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। তবে দীর্ঘায়িত গল্পচর্চায় তার ক্রম-বিবর্তন ঘটেছে। গল্পের ভেতর দিয়ে প্রতিরোধের প্রবর্তনাটি রচিত হয়েছে সমকালকে ঘিরে। সামাজিক দায়বোধে আধুনিকতার যাবতীয় গরল ধারণ করে তার গল্প। বাংলাদেশের গল্পধারায় তিনি এখনো সচল ও সক্রিয়।

প্রাসঙ্গিকভাবে ‘সাবিত্রী উপাখ্যানে’র আলোচনা করি। সাবিত্রী ‘কুলটা’। মনে আসে, রোহিনী-বিনোদিনী- কিরণময়ী-কুসুম- জমিলা-সখিনা-জারুনার মা-ফুলজান-সাবিত্রী জীবনের ধারাপাতের ধারা। কতটা এগিয়েছে সমাজ? নারীর মূল্য সমাজে কেমন? হাসান আজিজুল হক ধরে নেন এ পরিবর্তন ধারা সমাজসূত্রে কতটা! আদৌ কী স্বীয়-মন অধিকৃত নারী মানুষ গণ্য হয়েছে। উল্লিখিত চরিত্রই তো সময়। পুরুষ রক্তচক্ষুতে তা কতটা শোধন হয়েছে। আঘাতে কী উন্মত্ত নয়? সবাই মিলে শকুনের দলের মতো শোষকের ভাগাড়ে একপিক্ততে বসে দেহ শুঁকতে থাকে কেন? উঠে দাঁড়ালেই যেন তিলক এঁটে দেবে। ওসব আবার সবার সম্মুখেই বয়ে বেড়াতে হয়, প্রাণধারা বহে যতকাল! আর চুপকথার নানা ব্যঙ্গও তো আছে। সাবিত্রী উপাখ্যানে ‘কালচার অব সাইলেন্স’ অনেক কথা বলে। তারই উত্তর পেতে চান লেখক। সেটিই লেখকের দর্শন বা বার্তা। আর এমন ভাবনার মধ্যে পাঠক চিনে নেন বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ। লেখকের শামুক উপন্যাসের মতো এ উপন্যাসের ঘটনাটিও থার্টিজের, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের। মেলে আদালতের সাক্ষ্য। অনেকের সাক্ষ্য। তাই-ই প্লট-অনুসৃত কৌশল। খুব সন্তর্পণে কথক গেঁথে ফেলেন সচিত্র ঘটনা-রজ্জু। সেটি সাবিত্রীর মন, মুহূর্ত, বেদনা, স্বপ্ন-আনন্দ-কষ্ট-গ্লানি একদিকে যেমন দুর্মর করে তোলে তেমনি অন্যদিকে বটা-সবুর-দুর্গার পাশব-পৌরুষ প্রবৃত্তিত্রাস আচরণীয় সমাজের নির্গলিত তাপে সুদূরের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিনির্মিত। এটি নিছক কাহিনী নয়। ‘নেচার অব মিনিং’রূপে ন্যারেটিভ। ‘সাবিত্রীর চারপাশে সব একা। কেমন থেমে আছে। সাবিত্রীও একা হয়ে গেল।’ কথাশিল্পীই তার প্রবক্তা। তখন প্রবক্তার দৃষ্টিকোণে, সাবিত্রীকে ঘিরে নির্ধারিত সমাজ ও সমাজের দ্বন্দ্ব কিংবা সাংস্কৃতিক অভিঘাতসমূহ আর মূল্যবোধের গভীরতর টানাপড়েন তৈরি হওয়া। তাই তো সাবিত্রী খুব সাধারণ, ব্রাহ্মণ কিন্তু শরীর-সোহাগী আর অভূতপূর্ব শারীরিক গড়ন। সুশ্রী, সৌন্দর্যময় প্রত্যঙ্গ। নিপুণও। মনোলোভা ও আকর্ষণীয় অন্যের [অপর/ পুরুষ/ ‘বল’শালী পুরুষ/ ‘ক্ষমতা’শালী পুরুষ] কাছে। ‘অনেক চেষ্টায় দশটা টাকা জোগাড় করিয়া লোক মারফত পাঠাইলাম। বন্ধক অনন্ত ছাড়াইয়া লইও। কাহাকেও এসব কথা বলিও না। পৌষ মাসে বাড়ি আসিব’— তবে সবকিছু সঠিক ফলে নাই। অনন্ত ছাড়ানো যায়নি, সাবিত্রীকে পাওয়া যায়নি। ঠিক যে পর্যায়ে কথক অনিমেষ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন, তা সুরক্ষা হয়নি। দুকড়ির দৃষ্টি ফ্যাকাশে হয়েছে নলিন কেওটের মধ্যস্থতায়। ভূমিকা নেয়, তিনজন। উল্লিখিত সময়টা সুনির্দিষ্ট, ১৯৩৮ সালের ৮ নভেম্বর। তারপর বিস্তৃত ঘটনারাশি জড়ায়, স্তূপীকৃত হয় ছিন্ন ও কণ্টকীকৃত বিকট সব চিন্তাজালে। এর পেছনের সমাজসত্যটি কী? কিংবা তার দার্শনিক ব্যাখ্যা? কথক তো শুধুই কাহিনি বলেন না। ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ফলে শুধু সাবিত্রীর আখ্যান নয়, সমাজ-দর্শন ও ভূমি-মানুষের ইতিহাসে পরিণতির ইঙ্গিত কিংবা তার দ্বান্দ্বিক পুনর্গঠনে আর্থ-সাংস্কৃতিক কাঠামোর রূপ বা আরো নির্বাচিত-মনস্তত্ত্বে তা এই ভূমি-মাতৃকার বীজাঙ্কুরে প্রতীকী সাবিত্রীর টোটেম-ট্যাবুর প্রত্নমায়ার প্রপঞ্চ— যা এক জনপদের চিরন্তন রিচ্যুয়ালে অনুষ্ঠিত। এভাবে পরখ করলে, সাত বছরের সাবিত্রী যখন ষোলো-সতেরোয় পৌঁছায়— তখন অপহরণের কাল, বলাৎকার, ছিন্নভিন্ন শরীর বা মান-অপমান ও আঘাতের পর আঘাত নিয়ে বিচ্যুতিপ্রাপ্ত সমস্ত সামাজিক সম্পর্কের সত্তা শূন্যতায় এক অবসেশন নিয়ে দাঁড়ায় নিজের শর্তে, পেতে চায় অনির্বাণ অনলমুখো প্রতিরোধের শক্তি। এতে কাহিনীর জন্য কথকের নান্দনিক স্তরান্তরও আছে, আছে অতিক্রমের উদ্ভাস এবং অভিপ্রেত পর্যায়ও। কী করে আত্মঅবমান ক্ষয়িষ্ণু অভিমুখ পাচ্ছে, একের পর এক খানা-খন্দ, নদী-জলাশয়, বন-জঙ্গল, ভূমি সমতল-অবতল পেরিয়ে শুষ্ক জীবন পাওয়া— তাকে নিরানন্দ গ্রহণ-বর্জন, কঠিন-নম্র পদভারে নিরীক্ষণ, ভার ক্রমশ ভারাক্রান্ত— অতঃপর আরো অতিশয় তীব্র ও কঠোর ধর্ষিতা-জীবনের পারাবার— তার পীঠে আরো অন্য গল্পের রচনাক্ষেত্র। সেখানে নারী শুধুই এক শরীরে, পণ্যে, সবটুকু নিভন্ত— শুধুই বেঁচে থাকা যতক্ষণ শরীরের তাপটুকু একের পর এক পুরুষ গ্রাসাচ্ছাদন করতে না পারে। এ এক চরম ধারাবিবরণী— রাত্রি-দিনের চলতিক্রমে। হাসান আজিজুল হক (কথক) স্থান-বিবরণী দেন, পরিবেশ তুলে ধরেন, শত্রু-মিত্র, পাপ-পুণ্য, ভয়-নির্ভয়ের চাঞ্চল্যের পারিপাট্যে। সেই পটভূমে কর্কশ জটাজালের ক্ষয়িষ্ণু বেদনাভারে পালাক্রমে  ধর্ষিতার ওপর ধর্ষণক্রিয়া সুযোগ ও পরিবেশের যোগানে সংশ্লিষ্ট করা চলে। সাবিত্রী ব্যক্তি শুধু নয়, তাকে ঘিরে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততায় তৈরি। বেরিয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং আরও সম্প্রসারণে শ্রেণিমর্যাদায় জমিদার-মহাজন বনাম প্রজাদ্বন্দ্ব, তৃতীয় দশকের ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় জাতীয়তাবাদ থেকে সাম্প্রদায়িকতার উদ্গীরণ এবং এর কার্যকারণ প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে উপন্যাসের উপাখ্যানে। তাতে সাবিত্রীই কেন্দ্র। কিন্তু ওই টগবগ করে ফোটা পানির গতিবিধি নিরূপিত হয়। কথক তার বাস্তব গুরুত্ব নির্ধারণ করেন। ফলে সাবিত্রী কাহিনি আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। পায় আরো শ্লেষাত্মক অনুরণন, যা এ উপন্যাসের শিল্পে যুক্ত করে নতুন মাত্রা। আর সে লক্ষ্যেই তৈরি হয় উপন্যাসের ভাষা। কলকাতা থেকে বগুড়া, অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতি— ওই আঞ্চলিক ভাষায়।

‘শামুক’, ‘আগুনপাখি’র পরে ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ হাসান আজিজুল হককে যে অন্য উচ্চতা দিয়েছে তা বলতে দ্বিধা হয় না। তবে তার সঙ্গত স্বরূপ কী? উপন্যাসে ক্রমিক কথক বিবরণীটি আদালতের সাক্ষ্যকে অবলম্বন করে যে রিমার্কেবল পরিবেশ প্রস্তুত করেছে— আর তার এমন উচ্চতার সমার্থক বিবেচনা করলে, স্বজ্ঞার দর্শনটিই প্রতিষ্ঠিত হয়। চরিত্র-প্রধান হওয়ায় চরিত্রই এর ঘটনাদর্শন। আলো-ছায়া বা অন্ধকারের বিপ্রতীপ বলয়, আলোর প্রতিসরণ, ‘সন্ত’ সাবিত্রীর কিম্ভূত পরিবেষ্টন— সবই এক চমৎকার নান্দনিক প্রজেকশন। এটি তুল্যমূল্য কথা নয়, ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ সাবিত্রীর ঘোরে কাটলেও শ্রীকেষ্টপুর থেকে বগুড়ার জনপদের নিখুঁত নৃ-ইতিহাস বা প্রত্নচোখে সংস্কার-মূল্যবোধের অর্বাচীনতা চিনে ফেলা সক্ষম হয়। প্রসঙ্গত বলতেই হয় হাসান আজিজুল হক একুশ শতকে বসে প্রায় শতবর্ষ আগের এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও সমাজদ্বন্দ্বের স্বরূপকে চিনিয়ে দেন— সাবিত্রী তার অবলম্বন। কারণ, এ চরিত্রটি তো এখনো সমাজবিচ্যুত কেউ নয়! এভাবেই কথক হাসান আজিজুল হকের স্বরূপচিহ্ন নির্ণীত ও প্রবহমান। যেখানে আশি-অতিক্রমী তিনি এখনো নির্বিচার নিরন্তর কথক। ৎ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads