• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

বীথি আপা ও শহীদ মিনার

  • মোস্তফা তারিক আল বান্না
  • প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

সেদিন ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। একদিন পরই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের সুরে মূর্ছনায় ভরে উঠবে পুরো বাংলাদেশ। সালাম, রফিক, বরকত কিংবা জব্বারের উপমাবিহীন সেই ত্যাগের স্মৃতিচারণ হবে নানা প্রেক্ষাপটে। কৃষ্ণচূড়ার লাল টকটকে ফুলগুলো কি ওদের পবিত্র রক্তের বিজয় ঘোষণা করছে? মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে বরণ করতে রাজধানীর একটি কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কিছু সিনিয়র-জুনিয়র ছাত্রছাত্রী সম্ভাব্য অনুষ্ঠান সূচি নিয়ে আলোচনা করে। অনেকেই যার যার বাড়িতে চলে যায়। বাবু, কাঞ্চন, লিটন, বাবুল, সাদেক ও শহীদ তখনো কলেজ রুমে বসে ছিল।

কলেজের কয়েক কদম দূরেই বাবুদের বাড়ি। ভাইকে খুঁজতে বাবুর বড় বোন বীথি কলেজ চত্বরে এলেন। একুশের অনুষ্ঠানের কথা শুনে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘শুনলাম সঙ্গীত, কবিতা পাঠ, নাটক, ভাষা শহীদদের জন্য দোয়াসহ নানা আয়োজন করা হয়েছে। তোদের সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু কলেজ চত্বরে একটি শহীদ মিনার না থাকায় সবকিছু কেমন যে ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে।’

বাবুর বোন বীথিকে বাকিরা গভীরভাবে আপন বোনের মতোই শ্রদ্ধা করে। অত্যন্ত বাস্তববাদী নারী এই বীথি। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশপ্রেম নিয়ে পরিচ্ছন্ন ধারণা তার। বীথি আপা ওদের চোখ খুলে দিলেন। ওরা সিদ্ধান্ত নিলো ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে রাতের মধ্যেই একটা শহীদ মিনার তৈরি করা হবে।

রাত আটটার মধ্যে ওরা ছয় বন্ধু কলেজ চত্বরে ফের জড়ো হলো। শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত ওরা অবশ্য বীথি আপাকে জানায়নি। দুই বন্ধুকে কলেজে রেখে পাশের একটি নির্মাণাধীন বাড়ির চত্বর থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইট ও পরিমাণমতো বালি চার বন্ধু বহন করে কলেজের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এলো। সে সময় ওই বাড়িতে কেউ ছিল না। সিদ্ধান্ত হলো, দিনের বেলায় মালিককে জানানো হবে ইট ও বালু নেওয়ার কথা। তিনি রাগ করলে ইট-বালির টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। বাবু আগেই বলেছিল, সে বাসা থেকে সিমেন্ট ম্যানেজ করে দিতে পারবে। কিন্তু রাত একটার দিকে বাবু মলিন চেহারা নিয়ে জানালো, ‘সরি দোস্ত, বাসায় এখন সিমেন্টের কোনো বস্তা নেই।’ বাবুর কথায় সবার মন খারাপ হয়ে গেল। বাবুর মনও খারাপ। লিটন সান্ত্বনা দিয়ে বলল, বাবু তুই চিন্তা করিস না। সামনেই সিমেন্টের কয়েকটি দোকান আছে। টাকা না হয় কাল দিয়ে দেব। দেখি চাইলে দেয় কি-না। শহীদ, রিটন ও বাবু বেশ চেঁচামেচির পর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা এক দোকানিকে জাগাতে পারল। দোকানদার অবশ্য ওদের দেখেই চিনে ফেলে। পরিকল্পনার কথা শুনে দোকানদার বাকিতে দুই বস্তা সিমেন্ট দিতে রাজি হলো। লিটন একাই এক বস্তা মাথায় তুলে নিল। শহীদ আর বাবু নিল এক বস্তা। কাঞ্চন, বাবুল আর সাদেক কলেজের গেটেই ছিল। সিমেন্ট আনতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা।’ ছয় বন্ধুর মধ্যে বাবুকে সেরা কামলা মনে হয়।

কলেজের কমনরুম থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে এলো কাঞ্চন, সাদেক আর বাবুল। বাবু তখন বালি-সিমেন্ট মেশাতে থাকে অনুমান করে। বাবুকে সবাই সাহায্য করছিল। ইটের গাঁথুনি সে একাই করছিল। কলেজ বারান্দার একটি লাইট জ্বালিয়ে ওরা কাজ করছিল। এত রাতে কলেজের ভেতর লাইট জ্বালিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করার বিষয়টি টহল পুলিশ প্রথমে বোঝেনি। তারা কলেজের ভেতরে এসে বেশ গরম হয়ে ওঠে। তবে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তারা হাসি দিয়ে চলে যায়। ছয়জন তরুণের এমন কাজকে হয়তো বা তারা এক ধরনের পাগলামি মনে করে। যদিও ওই ছয়জনের কাছে সেটা ছিল একটা বিরাট জাতীয় দায়িত্ব পালনের মতো।

শহীদের পায়ে কোনো এক ফাঁকে একটা লোহার পেরেকের কিছুটা ঢুকে যায়। কিছুটা রক্তও ঝরছে। অবশ্য শহীদ মিনার তৈরিতে বাবুর মনোনিবেশ দেখে শহীদের পায়ের ব্যথাও যে উড়ে যায়, কমে যায়। রাত প্রায় চারটার দিকে বাবুল বলল, ‘আর পারছি না, খিদের জ্বালায় শরীর অবশ হয়ে আসছে।’ বাবুলের কথায় বাকি পাঁচজনও সম্মতি জানায়। আসলে শহীদ মিনার নির্মাণ নিয়ে ওরা এত বেশি উত্তেজিত ছিল যে, খাবার জোগাড় করে রাখার কথা চিন্তাই করেনি। দারোয়ান আবদুর রহমান কলেজের উত্তর দিকের গ্যারেজ থেকে একটা রিকশা ম্যানেজ করে দিল। শহীদ কাটা পায়েই রিকশা চালাতে শুরু করল। কাঞ্চন ও লিটন রিকশার আরোহী।

মালিবাগের দুটি ব্রেড ফ্যাক্টরিতে কিছুই পাওয়া গেল না। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের একটু দক্ষিণ দিকে একটি ব্রেড ফ্যাক্টরি থেকে গরম গরম দু’পাউন্ড পাউরুটি কিনলো ওরা। সিদ্ধেশ্বরী থেকে মৌচাক মার্কেটের পাশ দিয়ে আবুজর গিফারী কলেজের দিকে যাওয়ার পথে আবারো টহল পুলিশের মুখোমুখি হতে হয় ওদের। অবশ্য এবারো কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। সাদেক তখন বাবুর বাসায় গিয়ে কয়েকটি ডিম ভেজে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেয়। তবে তাতে সম্মতি দেওয়ার দরকার হয়নি বাকিদের। কারণ ক্ষিধের চোটে এমনিতেই পাউরুটি গলাধঃকরণ শুরু হলো। মোটামুটি সকাল ছ’টার দিকে, তিন স্তম্ভের শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ভোরবেলায় বাবুল ও সাদেক চুন আর লাল রঙ জোগাড় করে কলেজে ফিরল। শহীদ মিনারে সেগুলো লাগিয়ে দেওয়ার পর দারুণ লাগছিল। সকাল সাতটার পর শহীদ মিনার ঘিরে ওরা যখন বসেছিল, তখন বীথি আপা এসে হাজির। খালি হাতে নয়, একাও নন। কাজের ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে ভুনা-খিচুড়ি আর ডিম ভাজি ভর্তি বড় টিফিন ক্যারিয়ার।

‘খুব ভোরে হাঁটতে বের হয়ে কাজের ছেলের কাছে শুনতে পেলাম তোদের পাগলামির কথা। তোরা যে এত কষ্ট করে চমৎকার কাজটি করেছিস, এতে আমি ভীষণ খুশি। তোদের দেখে মনে হচ্ছে তোরা এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তোরা অনেক ছোট ছিলি। আমার মনে আছে, যুদ্ধের সময় শিশু-কিশোর তরুণদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল সবার চেয়ে বেশি। আজ তোরা যা করলি, এ কলেজ যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন তোদের কথা সবাই স্মরণ করবে’, বীথি আপা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন।

শহীদ বলল, ‘আপা খাবার দেখে প্রথমে খুব খিদে পেয়েছিল। কিন্তু আপনার এত চমৎকার কথা শুনে আমার খিদে চলে গেছে।’ কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বীথি আপা বললেন, ‘বড় কথা রাখ। আমি তোদের সবাইকে আজ নিজ হাতে খাইয়ে দেব।’ নিজের ছোট ভাই বাবুসহ সবাইকে পাশে বসিয়ে ভুনা-খিচুড়ি খাওয়ালেন বীথি আপা। খাওয়াতে খাওয়াতে শহীদ মিনার নির্মাণের কাহিনি শুনে চেখের পানি আর ধরে রাখতে পারেননি। আগের দিনও যেখানে শহীদ মিনারের কোনো চিহ্ন ছিল না, সেখানে এক রাতের মধ্যেই আস্ত শহীদ মিনার! আশপাশের লোকজন তা দেখতে আসছে। সকাল দশটার মধ্যে সেখানে রীতিমতো বিশাল জমায়েত হয়ে গেল।

সকাল এগারোটার দিকে কলেজের উদ্যোগে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রিন্সিপাল স্যার তো আস্ত শহীদ মিনার দেখে অবাক হয়ে যান। সব কাহিনি শোনার পর বললেন, ‘তোরা কলেজের সোনার ছেলে।’ শহীদ বলল, ‘স্যার বীথি আপার অনুপ্রেরণায় আমরা এটা করেছি।’ স্যার বললেন, ‘বীথিও সোনার মেয়ে।’ ৎ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads