• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
বীরেন মুখার্জীর কাব্যশৈলী

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

বীরেন মুখার্জীর কাব্যশৈলী

  • প্রকাশিত ০২ মার্চ ২০১৯

নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে যারা কবিতায় নন্দনতত্ত্বে বৈচিত্র্য অন্বেষণ করেন, তাদের অন্যতম বীরেন মুখার্জী। আর নন্দনতত্ত্ব এমন এক সৌন্দর্যভুবন যার অনুসন্ধান করতে কেউ দৈনন্দিন বাস্তবতায় অবগাহন করেন, কেউ আধ্যাত্মিক দর্শন; কেউ আবার প্রকৃতি সন্ধানে মগ্ন হন। রবীন্দ্রনাথে যেমন আমরা আধ্যাত্মদর্শনের মগ্নতা দেখি, তেমনি জীবনানন্দে পাই প্রকৃতি চেতনার অনুষঙ্গ। বোধের উন্মোচন হয় নন্দনতত্ত্বের সৌন্দর্য চেতনায়। আধুনিককালের কবিদের মধ্যে নন্দনতত্ত্বের বিমূর্তায়নের বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। কবিতায় স্বদেশ-স্বকাল, ইতিহাস-মিথ, প্রত্ন-চেতনা ইত্যাদির পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, অর্থনীতি সবই উচ্চারিত হয় নন্দনতাত্ত্বিক অনিন্দ্যতায়। আবার কবি যখন ঋষির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন তাকে ত্রিকালদর্শীর ভূমিকায় দেখা যায়। বীরেন মুখার্জীর কবিতা পড়ে কবিতার এমনসব গূঢ় জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হয় পাঠককে। তার কবিতায় নতুন চিত্রকল্প আবিষ্কারের প্রয়াস যেমন দেখতে পাই, তেমনি প্রয়োগরীতিতেও কিছুটা নতুনত্বের আস্বাদন পাওয়া যায়; যে কারণে বীরেন-এর কবিতায় প্রায়ই বিমূর্ততার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়; এতকিছুকে ধারণ করেও তার কবিতা ঐতিহ্য এবং শেকড়সন্ধানী হওয়ার কারণে বোধের অতীত নয়। তার কবিতার শব্দচয়নে যেমন আছে লোকজীবন তুলে আনার চেষ্টা; তেমনি তার উপস্থাপনশৈলীতে আছে পরম্পরার প্রতি নিষ্ঠ থাকার আকর্ষণ। এতসব সচেতন নির্মিতির যোগে বীরেন-এর কবিতা উত্তরাধুনিকতার আলোয় আলোকিত হয়েও ক্লাসিক ঘরানার; বিমূর্ততায় আবৃত হয়েও দুর্বোধ্যতায় নিমজ্জিত নয়।
কবিতায় গতিময়তা চাই, গতিশীলতা চাই, কবিতার শব্দ-বাক্য-উপস্থাপনা সাবলীল হওয়া চাই; তাহলেই উত্তীর্ণ কবিতা পাব; যে কবিতা তৃপ্তি দেবে। প্রথমত, আমি বীরেন-এর কবিতায় সে প্রশান্তি পেয়ে যাই, তাই তাকে পুনর্বার পাঠ করি। বারবার পড়েও সহজ সিদ্ধান্তে আসতে পারি না কোন্ তালিকায় বীরেন-এর নাম উচ্চারণ করব। তাকে নিয়ে এই যে দোলাচাল, তখনই বুঝতে পারি বীরেন মুখার্জী এ সময়ে ভাবনায় আনার মতো একজন কবি। বীরেন জানেন ডালায় রাখা ফুলগুলো মালা নয়? ফুলগুলোর মালা হয়ে উঠতে তাদের গ্রন্থিত হওয়া চাই, ফুলের সঙ্গে সুতোর যোগ হওয়া চাই। আবার ফুলের যেমন বৈচিত্র্য আছে তেমনি আরো বিচিত্র ফুলের শিল্পিত বিন্যাসে মালায় অনেক বেশি বৈচিত্র্যযোগের অবকাশ আছে; উত্তীর্ণ কবিতা হবে দৃষ্টিনন্দন ফুলমালা। কবিতার শব্দগুলো এক একটা ফুল। বিন্যাসটাই বড় বিষয়, বিন্যাসের জন্য চাই শিল্পবোধ। তাই তো কবিকে হতে হয় শিল্পী। বীরেন মুখার্জীর কবিতা পড়ে বুঝতে পারি, তিনি বিন্যাসটা ভালো বোঝেন, বিন্যাসের শিল্পরীতিও বোঝেন।
আমরা যদি তার পালকের ঐশ্বর্য কাব্যটি হাতে নিই, দেখব সেখানে মোট ৪২টি কবিতা সংকলিত হয়েছে; যার মধ্যে বেশক’টি টানা গদ্যে লেখা কবিতাও আছে; অবশ্য বাকি সব কবিতা যে প্রথাগত ছন্দে লেখা তা কিন্তু নয়; বরং বলতে পারি সবই মুক্ত গদ্যে লেখা। তারপরও অধিকাংশ কবিতায়ই অক্ষরবৃত্তের দোলা লক্ষণীয়। প্রথমত কাব্যের নামকবিতা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি— ‘পৌরাণিক অন্ধকার ছুঁয়ে, নিয়তিশাসিত মানুষ বৃথা খোঁজে, কোলাহলমুখর সন্ধ্যা। আঁচলের আড়ালে আকাশ ঢেকে খুলে রাখে দ্রোহের মৌনাস্ত্র; পরিবর্তিত আঙুল অচল আধুলিতে সাজিয়ে রাখে— চুম্বনের অধরা বায়োস্কোপ! চোখের খামারে শাদা ভোর দেখে যে মানুষ ছোটে পার্থিব ভুলের বাগানে, সেখানে জলের নূপুরে বাজে সম্ভ্রান্ত রোদ! সূর্যাস্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখোশ পরা চাঁদ মফস্বলী উঠোনে তাড়ায়—চেতনার বালিহাঁস।’
(পালকের ঐশ্বর্য \ পালকের ঐশ্বর্য \ পৃষ্ঠা-১১)

উপরের সামান্য ক’টি পিক্ত থেকেই আমরা পড়ে নিতে পারি তার শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাসশৈলীর মুন্সিয়ানা। টানা গদ্যে লেখা এ কবিতার গতিময়তা তার পাঠককে আকৃষ্ট করে; প্রবহমানতায় কোথাও সামান্য ছেদ পড়ে না; এবং এখানেই বীরেন মুখার্জীর কাব্যস্বভাবে বনেদিপনা আর মৃত্তিকালগ্নতা টের পাই; টের পাই তার পরম্পরার প্রতি আস্থা।
একজন কবির কবিতাযাত্রায় বেশকিছু অধ্যায় তাকে অতিক্রম করতে হয়, সবচেয়ে জটিল অধ্যায় শব্দবিন্যাস রপ্ত করা, শিল্পবোধটা জাগিয়ে তোলা; সেটাই প্রাথমিক পর্যায়ের একজন কবিতাকর্মীর জন্য জরুরি। বীরেন তো প্রাথমিক পর্যায়ের কবি নন, ইতোমধ্যেই তিনি অতিক্রম করেছেন অনেকটা পথ; এখন আমরা তাকে পরিণতই বলতে পারি; পরিণত জেনেই আমি তার শেষের দিকের তিনটি কাব্য বেছে নিয়েছি আলোচনার জন্য। এবারে আমি আলোচনায় আনবো কবির হেমন্তের অর্কেস্ট্রা, যেটি তার অষ্টম কাব্য। এ কাব্যে অন্তত তিনটি কবিতার শিরোনামে ‘হেমন্ত’ শব্দটি আছে, তবে পৌষ-চৈত্র বা অন্যান্য ঋতুর উপস্থিতিও দেখতে পাই। এ কাব্য থেকে আমি তার কবিতার ঋদ্ধি বুঝতে একটিমাত্র কবিতা উদ্ধৃতি দিচ্ছি—
কতটুকু প্রকাশিত তুমি ফুল ও ফসলে
খোঁপা খোলা শাদা পোশাক কিংবা দীর্ঘ আবর্তনে
বিলিয়েছো কতটুকু আন্তরিক নির্যাস,
শিরস্ত্রাণ থেকে খসে যাওয়া গোধুলিসন্ধ্যায়
কে প্রথম কুড়িয়েছে—আলোর সন্ন্যাস,
পুষ্পায়িত হতে হতে কারা গেছে ভ্রমণের রথে
কিংবা, উজ্জ্বল সঙ্গম শেষে কার চোখে
পুনর্বার জেগেছে পরিতৃপ্ত হাসি,
প্রকৃত আয়না জানে তার সবটুক।
(প্রকৃত আয়না \ হেমন্তের অর্কেস্ট্রা \ পৃষ্ঠা-৩৪)
ভাব ছাড়া কিছুতেই লিখতে পারেন না একজন কবি। ঘোরগ্রস্ততা তাই সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এক আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। কবিতার সেই ঘোরটিকে বীরেন মুখার্জী আয়ত্ত করেছেন সযত্নে। আবার কবিতার সুচারু বিন্যাসের জন্য শব্দ এবং ভাষা সমন্বয়ের ব্যবচ্ছেদটাও জানতে হয় কবিকে। শল্যচিকিৎসার জন্য ছুরিটা চালাতে জানতে হয়, ছুরি চালানো শেখার আগে ছুরি ধরার কৌশলটা জানতে হয়। তেমনি কবিতার বিন্যাস প্রক্রিয়ায় পারঙ্গম হতে হলে এর উপস্থাপনশৈলীর বৈচিত্র্য আয়ত্ত করা লাগে। সেটিও বীরেন মুখার্জী আয়ত্ত করেছেন সযত্নে। কবির তৃতীয় কাব্য গুচ্ছঘাসের অন্ধকার প্রসঙ্গে বলার জন্যই এত কথার অবতারণা করেছি। তার এ কাব্যটি পড়লেই জানা হয়ে যায় বীরেন জীবনের বাঁক ঘুরে ঘুরে কীভাবে নিজেকে পূর্ণতার পথে এনে দাঁড় করিয়েছেন; এখানে আমার অবকাশ নেই দীর্ঘ আলোচনার, শুধু বলবো গুচ্ছঘাসের অন্ধকার কাব্যে মোট ৪৯টি কবিতা স্থান পেয়েছে এবং সূচনায় কাব্যটি নিয়ে কলকাতার কবি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছে।
বীরেন মুখার্জীর কাব্য অভিযাত্রা সহজ নয়। তার এগিয়ে চলার পাশে তার বন্ধুরা যেমন ছিলেন, ছিলেন তার প্রতিপক্ষের মানুষও; কিন্তু বীরেন তার অভীষ্ট থেকে কখনো বিচ্যুত হননি; তার কাব্যযাত্রার একজন অগ্রজ-সুহূদ হিসেবে তাকে আমি তাই অভিনন্দিত করতে চাই। ভালোবাসা বীরেন, সুন্দরের জন্য আমাদের প্রতিটি সংগ্রামে লড়াইয়ের মাঠে দেখা হবে বার বার।

 

ফরিদ আহমদ দুলাল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads