• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

দখিন জানালা

  • সিগমা আউয়াল
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০১৯

আমার এই দখিনের জানালাটা সবসময় আমার মাথার পেছনে থাকে। শুয়ে থাকলে বা পাশের সোফায় বসলে তাকে আমি ধরতে পারি, ছুঁতে পারি। তার সঙ্গে কথা বলতে পারি, মন খারাপ হলে তার কাছে নালিশ করতে পারি। সে আমায় সান্ত্বনা দেয়, আমার সঙ্গে মনের কথা বলাবলি করে। মাঝে মধ্যে অজানা পাখি এসে কিচিরমিচির করে ওদের ভাষায় অনেক কথা শুনিয়ে যায়। ভাবছি ওদের ভাষাটি  শিখে নেব। বৃষ্টি পড়লে আমি জানালার পাশে বসে  মাটির সোঁদা গন্ধটা উপভোগ করি। যখন ঝমঝম করে মুষল ধারায় বৃষ্টি হয়, যখন বৃষ্টি প্রায় আমায় ভিজিয়ে দেওয়ার অবস্থা করে তখন আমি গ্লাসটা টেনে দি। কিন্তু তারপরও বসে থাকি অনেকক্ষণ। আগে ঝড়কে ভয় পেতাম। বাজকে ভয় পেতাম। তখন বাচ্চাদের নিয়ে গোল হয়ে খাটের মাঝখানটায় বসে থাকতাম। ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজে আমার ছেলেটা ভয়ে একবার আমাকে, একবার ওর বাবাকে প্রশ্ন করত- এটা কিসের শব্দ বাবা? আমরা খুব মজা করে ছেলেকে ভয় দেখানোর জন্য বলতাম- এটার নাম ‘মাংকি ইসপা’। ভুতুড়ে সব গল্প ফেঁদে বসতো ওর বাবা, ছেলে-মেয়ে তো সব ভয়ে আধমরা হয়ে যেত। তখন তো কারেন্ট থাকত না। মোমের মৃদু আলোয় রহস্যময় লাগত সেসব গল্প। 

আমিও একটু ভয় পেতাম তখন। এখন আর ভয় পাই না। এখন ঝড় দেখি। ঝড়ের সঙ্গে মোকাবেলা করি। মাঝে মধ্যে ঝগড়া করি, বলি তুমি এমন কেন? ঠুনকো হয়ে যাওয়া জিনিস বেশিক্ষণ জোড়া দিয়ে রাখা যায় না। এ কেমন তোমার জীবন-সংসার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! 

তারপরও ঠাঁয় আমি বসে থাকি বারান্দায় অথবা আমার দখিন জানালাটার পাশে। কালো আকাশ  রক্তিম আকার ধারণ করে, মনে হয় ঝড় আমায় চোখ রাঙাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। থোড়াই কেয়ার করি তোমায় আমি। আমি তোমার সব দুর্বলতা জানি, মিথ্যা তুমি আমায় ভয় দেখাও কেন?

সবাই বিশ্বাস ভঙ্গ করলেও দখিন জানালাটা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তার কারণ ওকে আমি খুব ভালোবাসি। আমার মতো করে। ওরও তো মনের কথা বলার বা শোনার কেউ নেই।

নীরুর খুব সকালে ওঠার অভ্যাস। আস্তে করে ওঠে যেন পাশের জনের ঘুম ভেঙে না যায়। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। বাহ্, এত সকালে লোকজন উঠে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। কেউ একা আবার কেউ দলবদ্ধভাবে, ভালোই লাগে দেখতে। ওরও তো সকালে হাঁটতে ভালো লাগত। কিন্তু একা একা হাঁটতে মন চায় না।

হাঁটার গতিটা বাড়ে না। সাজিদ হাঁটে সন্ধ্যার পরে। প্রায়ই নীরু বলে হাঁটতেই যখন হবে, তবে বিকেলে না, সকালে হাঁটলেই তো হয়? আমিও হাঁটতে পারি।

— নীরু তুমি হাঁটবে আমার সঙ্গে। হো হো করে সাজিদ হেসে অস্থির। সাজিদ বলে, তুমি এত ফাঁকিবাজ কেন! একই তো কথা, হাঁটতে হবে সেটা যখনই হোক। সকালে না হেঁটে বিকালে হাঁটলেই পারো।

- না, পারি না এত লোক, তারপর অন্ধকার হয়ে যায়। তুমি তো আমায় ফেলে আঁধারের মধ্যে কোথায় কোনদিকে চলে যাও। আমি এত দ্রুত হাঁটতে পারিনে বাপু।

— তা পিঁপড়ের গতিতে হাঁটলে হবে?

অনেক কাল আগের কথা সেটা। সাজিদের সঙ্গে বিয়ের পরের কথা। বাবার বাড়িতে এসেছি কিছুদিন থাকব বলে, সাজিদও সঙ্গে ছিল। হঠাৎ মনে হলো ওর কিছু কাপড়-চোপড় ধোয়া দরকার, কাজের লোকের কাছে দিতে লজ্জা হলো। আবার সাবান কিনব সেটার জন্য পয়সা তো নেই হাতে। কী করি, মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। আলমারিতে এক ড্রয়ারে টাকা রাখে সাজিদ। নীরু তো জানে, তাকে তো  রাখতে দিয়েছে। অথচ কেমন একটা সংকোচ লাগছে টাকাটা ধরতে নীরুর।

ভাবছে কদিনের পরিচিত একজন লোক। স্বামী হতে পারে, তার জন্য তার কাছে টাকা চাইতে হবে? মার কাছে যেতেও ভীষণ লজ্জা লাগছে। নীরুর মুখের অবস্থা দেখে সাজিদ নিজেই মনে হয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে, বলল, কিছু বলবে? কিছু আনতে হবে তোমার জন্য? মুখ নামিয়ে নীরু মাথাটা হেলিয়ে বলল, না না কিছু লাগবে না।

গভীর দৃষ্টি হেনে অফিসে যাওয়ার পথে সাজিদ বলল, আজ ফিরতে একটু দেরি হবে, বাসায় যাব, সবসময় শ্বশুরবাড়িতে থাকলে, ঘরজামাই ভাববে যে মানুষ।

তারপর না পেরে নীরু বলেই ফেলল, তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?

আকাশ থেকে পড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে সাজিদ বলে, কত টাকা? কী দরকার বলো তো?

করুণ মুখে নীরু বলে, একটা জেট কিনব।

অবাক বিস্ময়ে সাজিদ হো হো করে হেসেই যাচ্ছে। আর নীরু মরমে মরে যাচ্ছে, ছিঃ! কী লজ্জা কী ভাবল সাজিদ? না না, আর কোনোদিনই চাইব না।

সাজিদ নীরুর হাত দুটো মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, টাকা তো আছে তোমার কাছে। তুমি তো জানো, তবে আমার কাছে পারমিশন নিতে হবে কেন? তোমার দরকারমতো খরচ করো।

— তাই কি হয়? তোমার টাকা।

— আমার টাকা কি আলাদা!

তারপরও নীরুর জড়তা কিছুতেই যায় না। বারো টাকা দিয়ে নীরু জেট কিনে আনে। নিজে ধুয়ে নিজেই ইস্ত্রি করে স্বামীকে চমকে দেওয়ার ইচ্ছে তার। কী সব অদ্ভুত ইচ্ছে ছিল ছেলেমানুষের মতো ভাবে নীরু আর হাসে মনে মনে।

সময়ের সঙ্গে দিনের কত ফারাক। আজ তারা দুটো মানুষ কত কাছের। কথা বলার আগেই চেহারা দেখে একজন আরেকজনকে বুঝে নিতে পারে। সাজিদের মুখের দিকে তাকিয়ে এক পলকে নীরু বুঝে যায় মন খারাপ না শরীর খারাপ। প্রথম প্রথম কিছুতেই বলতে চাইত না। সারাক্ষণ পেছনে লেগে থাকলেও না। নীরুও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী না—  শোনো, তাকিয়ে থাকত দু মিনিট...। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads