• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

ক্যামেরাও ছিল তার সঙ্গে

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৭ মার্চ ২০১৯

যাকে নিয়ে লিখছি তার নাম এস এম সফি। সফি কেবলই একটি নাম বা একজন মানুষ নয়। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ফটো সাংবাদিক। এই বিশেষণকে অনেকের কাছে তেমন কিছু মনে নাও হতে পারে। কাঁধে লেন্সযুক্ত ক্যামেরা, হাতে স্টেনগান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন কঠিন সন্ধিক্ষণে কীভাবে এ দুটো কাজ একযোগে চালিয়ে যাওয়া যায় তা তিনি সমান দক্ষতার সাথেই করেছেন। তিনি যা করেছেন তা একটি দুরূহ কাজ। একসঙ্গে এমন দুটি কাজ করা প্রায় অসম্ভব, অসাধ্যকর।  কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন-মরণ সংকটে থাকে যোদ্ধারা। যেখানে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে যুদ্ধের বাস্তবতা ক্যামেরাবন্দি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও সত্যি হলো, এই অসাধ্যকর কাজটি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময়ে যশোরের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিরোধ ও যুদ্ধের বীভৎসতার দুর্লভ মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করে সাহসিকতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সংরক্ষণকে করেছেন সমৃদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ তখন চলছে। এলাকা যশোর। এক হাতে স্টেনগান আর অন্য হাতে ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধিকার আন্দোলনে। গঠন করেছিলেন গেরিলা বাহিনী। কিন্তু জীবন যখন মৃত্যুর মুখোমুখি তখনো তিনি অস্ত্র আর ক্যামেরা হাতছাড়া করেননি। জীবনবাজি রেখে তুলেছেন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের বাঙালি দোসরদের নির্মমতার ছবি। খালে-বিলে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র ইতিহাস সংরক্ষণ করেছিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অমর সৈনিক এস এম সফি রয়ে গেলেন প্রচারের বাইরে। কাঁধে লেন্সযুক্ত ক্যামেরা, হাতে স্টেনগান, দুচোখ সজাগ-শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। একই সাথে আবার ক্যামেরাবন্দি করতে হবে যুদ্ধদশার ছবি। অনেক দুর্লভ মুহূর্তকে সাহসিকতার সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি। ইতিহাসের অমর সাক্ষী হয়ে থাকবে এসব ছবি। এই ছিল প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা। শত্রুমুক্ত প্রথম জেলা যশোর। দিনটি ছিল ১১ ডিসেম্বর। সেই দিনটিকেও তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। ওই দিন যশোর টাউন হল মাঠে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভার ছবিও তুলেছেন তিনি। যুদ্ধ শুরুর আগে ৩ মার্চ টিঅ্যান্ডটি অফিসের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রথম শহীদ চারুবালা করের মৃতদেহ নিয়ে মুক্তিকামী মানুষ মিছিল করে। ওই দিনের ছবিও তার ক্যামেরায় বন্দি হয়ে আছে। আরিফপুর এলাকায় ট্রেনের ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে, বুলেটবৃষ্টির মধ্যে, হানাদারদের গুলিতে নিহত নিরীহ বাঙালির ছবি তুলেছেন।

এস এম সফি শুধু যশোরেরই নন, বাংলাদেশের সূর্যসন্তান। তার স্ত্রীও ছিলেন রণাঙ্গনের সঙ্গী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় তার পৈতৃক পাকা বাড়িটি পাকিস্তানিবাহিনী মর্টার হামলায় ধ্বংস করে। যুদ্ধ শেষে অনেক ছবি এস এম সফি ঘনিষ্ঠজনদের দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের সংকলনে সেই ছবি ছাপা হয়েছে। নিজের তোলা ছবি দেখে তিনি ফিরে যেতেন রণাঙ্গনের দিনগুলোয়। এটিও ছিল তার আরেক সংগ্রাম।

মুক্তিযোদ্ধা ও আলোকচিত্রী সাংবাদিক এস এম সফির জন্ম ১০ আগস্ট ১৯৩৪, যশোরের চুড়িপট্টির একটি সাধারণ পরিবারে। পিতা মৃত শেখ দলিল উদ্দিন, মাতা মৃত আকলিমুন্নেসা। শৈশব কেটেছে ভারতের দার্জিলিংয়ে। জলপাইগুড়ি শহরের একটি স্টুডিওতে চাকরি করার সুবাদে ক্যামেরায় হাতেখড়ি। কিশোর বয়সে দার্জিলিংয়ের চা বাগানের ছবি তুলেছেন। এরপর ১৯৬২ সালের দিকে যশোরে আসেন। এস এম সফি ছিলেন ডানপিটে স্বভাবের। ক্যামেরা, ফটোগ্রাফি বিষয়ে উন্মাদ ছিলেন। বাকিতে পেপার কিনে ছবি বানিয়ে দিতেন অনেক সাংবাদিককে।

১৯৬৩ সালে শহরের রেল রোডে ‘ফটো ফোকাস’ নামে তিনি একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি যেমন গেরিলা যুদ্ধ করেছেন তেমনি ৫শ’রও বেশি ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করে পুরো বিশ্বকে বর্বর পাকিস্তানিবাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য ছড়িয়ে দেন। ঢাকা ও যশোরে এস এম সফির আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৩ সালে সফি তার উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্র নিয়ে একটি বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করেন। তার আলোকচিত্রের সর্বশেষ প্রদর্শনী হয় ১৯৯৪ সালে ঢাকায় ল্যা গ্যালারিতে। এ ছাড়া ১৯৯৭ ও ’৯৮ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, যশোর জেলা শাখার ১৮ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান, ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা আলোকচিত্রী এস এম সফিকে উৎসর্গ করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক যশোর সেনানিবাসে ‘গৌরবাঙ্গন’, রংপুর সেনানিবাসে ‘শাশ্বত বাংলা’, ময়মনসিংহ সেনানিবাসে ‘ভাস্মর চেতনা’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি অনন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সাংবাদিক অভিধান প্রকাশনায় একজন দক্ষ সাংবাদিক হিসেবে তার স্বীকৃতি রয়েছে। দৈনিক আজকের কাগজে এস এম সফিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল— ‘অর্থাভাবে প্রকাশ করা যাচ্ছে না আলোকচিত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা এস এম সফির ক্যামরায় ধারণ করা মুক্তিযুদ্ধের ছবির অ্যালবাম’। সংবাদটি সংরক্ষণ করেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের আইয়ুব হোসেন। তারপর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘হেল্প দি ডিস্ট্রেসড-এর অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় এস এম সফির আলোকচিত্র নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই অ্যালবামের জন্য ছবি নির্বাচন, সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। কিন্তু সফি আর দেখে যেতে পারলেন না তারই ছবির আয়োজনে প্রকাশিত অ্যালবামটি। কেননা, এটি প্রকাশের আগেই এই মহান আলোকচিত্রী ১৯৯৭ সালের ১০ আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে যশোরে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। এস এম সফি স্টুডিও ফটোফোকাসের প্রতিষ্ঠাতা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন ‘চেতনা’র প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। মুক্তিযোদ্ধা নিমিকাওয়া ট্রেনিং স্কুল ক্রীড়া সংগঠন তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। এমন অসংখ্য কর্মের স্বাক্ষর রয়েছে তার জীবনচরিতায়। আলোকচিত্রের মাধ্যমে বৃহত্তর যশোরের মুক্তিযুদ্ধকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে নিজের ক্যামেরাবন্দি করা দুর্লভ ছবির সংগ্রহ প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরে বোধ ও চেতনার জাগরণ ঘটাবে। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads