• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

যুদ্ধ ও কাঁসার থালা

  • সজল বিশ্বাস
  • প্রকাশিত ২৭ মার্চ ২০১৯

বিকেল-রোদের বর্ণিল-ছটা স্টলের আলমারির কাচে লেগে বিম্বিত হয় চোখের মণিতে। যেন এক লহমায় সিনেমার সিনগুলো গলে গলে চোখের গোপন গর্তে জমা হতে থাকে। তখনো চায়ের শেষ চুমুকটা অধীর-অপেক্ষমাণ। গাড়ি ছাড়ি ছাড়ি। শেষ ঘণ্টির পরে শেষ হুইসেল। সদ্য স্বাধীন দেশে সদ্য মেরামত করা রেলপথ, ঈশ্বরদী টু সিরাজগঞ্জ— লোকাল ট্রেন। ছেড়ে যেতেই দৌড়ে উঠলাম। আসন জুড়ে কতিপয় যাত্রী, চোখেমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ। বিষণ্নতা। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না দেশটা স্বাধীন হয়েছে। বিহারীপাড়া, লোকোশেডের কোথাও কোথাও এখনো ধোঁয়া উঠছে। সেই কবে থেকে স্টলগুলো বিহারীরাই চালাত, এখন কে কোথায় ভেগেছে না মরে গেছে— কে জানে! তাই তো স্টলগুলো বন্ধ, মাত্র কয়েকটি খোলা, দখল নেয়া বাঙালির তত্ত্বাবধানে। জানালার ধারে বসে ভাবছিলাম। এখানেও ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারি আর তাদের এ দেশের দোসর।

এলোমেলো গোঁফ-দাড়ি আর বাবরি-চুলো আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে, যুদ্ধ শেষ করে আজ আমি বাড়ি ফিরছি? হ্যাঁ বাড়ি, কী আছে ওখানে, কে আছে ওখানে, সবই তো শেষ!  এক যাত্রী গভীরভাবে দেখছিলেন আমাকে। হয়তো বুঝে নিয়েছেন— আমি মুক্তিযোদ্ধা। বললেন, যুদ্ধ শেষ হলো, এখন কী ভাবছেন,  কী করবেন আপনারা?

এর উত্তর সঠিক জানা নেই। মনে মনে বলি— অস্ত্র জমা দিয়েছি, সব না। কিছু রাখা আছে। রেখেছি, আমরা যারা এদেশে থেকেই এদেশকে শত্রু-মুক্ত করতে চেয়েছি, ভারতে যাইনি। দেশটি পাকিস্তানি দখলমুক্ত হলেও এ দেশীয় বুর্জোয়াদের দখলে চলে গেছে। মেহনতি মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিক-রাজ কায়েমের সংগ্রাম শেষ হয়নি, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য আবার সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে সমাজতন্ত্রের জন্য, সর্বোপরি সাম্যবাদের জন্য। সে পথ অনেক আঁকাবাঁকা, কিন্তু উজ্জ্বল।

জানালার ওপারে সন্ধ্যা সমাগত প্রকৃতি। চলমান ট্রেন দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছে। কাজ শেষে কৃষক-শ্রমিক বাড়ি ফিরছে, ‘কাঁধে তার রাইফেল একখানি’... পড়া কবিতার কথা মনে হয়। অসমাপ্ত সংগ্রাম শেষ করার স্বপ্নে খানিক বিভোর থাকি। কবিতার কথা মনে এলেই মনে পড়ে একটি মুখ, মুখরিত ছিল কবিতার উচ্চারণে। যুদ্ধাঙ্গনে যার অনুরণন শুনেছি কেবলি। ‘শিউলি’। সে কী আছে! কোথায় আছে! ‘আমি কোথায় পাব তারে’...!    

বিলের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া রেলপথ ধরে একটি নির্জন-নিঃস্ব-স্টেশন। নেমে পড়ি। অনেক স্মৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে ওই যে পাখা, কখনও আপ কখনও ডাউন। দিগন্তে হাত বাড়িয়ে যেন বলছে... ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা’। ওর সাথে আমার অনেক কথা, অনেক সখ্যতা, কৈশোরকালে, সকালে-বিকালে বসে থাকা, জড়িয়ে ধরা। হুইসেল দিয়ে ট্রেনটি ছেড়ে গেলে পর চেয়ে থাকি। শব্দ দূরে সরে গেলে, কী এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে নিমেষে। স্টেশনে প্রাচীন চিমনির মধ্যে আলো জ্বলে ওঠে। ছেলেবেলায় মনে হতো— এ এক অলৌকিক আলো। ক্রমশ স্টেশন-কক্ষে ঢুকি। গায়ে চাদর জড়ানো আমাকে দেখে একজন বলে ওঠে, কোথায় যাবেন, এখন তো ট্রেন নাই, সারাদিনে একটাই যাওয়া আসা করে। উত্তর না দিয়ে আবছা আলোয় দেয়ালগুলো দেখি। যত্রতত্র ফুটাফাটা, বুঝতে বাকি থাকে না— গুলির দাগ। লোকটি বলে, কী দেখছেন, ভীষণ যুদ্ধ হইছে এখানে। স্টেশনে রাজাকারের ক্যাম্প ছিল। প্রতিরাতেই ওরা দশ-পনেরোজনকে ধরে এনে এইখানে গুলি কইরা মারছে। যে যে বাড়িত থিকা মুক্তিবাহিনী হইছে, সেইসব বাড়ির সব্বাইরে নির্মমভাবে মারছে। পুরুষ-মহিলা কাউরেই বাদ দেয় নাই। যুবতী মেয়েদের টেনে হেঁচড়ে ট্রেনে তুলে দিছে। এই ঘরের পেছনেই গণকবর।

গাঢ় সন্ধ্যায় টিমটিমে বাতি-জ্বলা স্টলে ঢুকলাম। পুরো স্টেশনজুড়ে একটাই ঝুপড়ি স্টল। ট্রেন আসার আগে খোলে, চলে গেলে চুলা নিভিয়ে ঝাঁপ নামায়। অগত্যা এক কাপ চা পাওয়া গেল। স্টেশন লাগোয়া ভগ্নপ্রায় কংক্রিটের বেঞ্চ। তাতেই বসে গণকবরমুখো হয়ে একটার পর একটা তিস্তা সিগারেট জ্বালাই। নাকি নিজেকে জ্বালি। জানি এখানেই আমার সব শুয়ে আছে। যুদ্ধে যাবার কালে দেখা মায়ের মুখখানা, আর চেনাজানা সবার মুখ, তিস্তার ধোঁয়ায় মিশ খেয়ে হালকা কুয়াশায় মিলেমিশে একাকার। দেখতে পাই। আমার বোনকে টেনে টেনে ট্রেনে তুলে দেওয়া হচ্ছে। হালকা কুয়াশা-কাফন আমাকে জড়িয়ে ধরে, বুকের পাঁজর পেঁচিয়ে ধরে। ভোর হলে পরে পথে নামি। চেনা মাঠ, চেনা পথ, চেনা বট এখন কেমন অচেনা! রেললাইনের সমান্তরালে কিছুটা, বাকিটা বিলের মাঝ দিয়ে সোজা উত্তরমুখো আমাদের গ্রাম। শিউলিদের বাড়ি। সকালের শুকনো বিলে কর্মযুক্ত অনেককেই আমি চিনতে পারলেও আমাকে চেনেনি কেউ। আমি মুক্তিযোদ্ধা, তোমাদের মুক্তির জন্যই লড়াই করে ফিরছি, অথচ চিনছ না! না চেনাই ভালো। তোমাদের জন্য এখনো অনেক কাজ বাকি।

এই তো আমার গ্রাম। সবই পুড়ে যাওয়া। নতুন বানানো ঘর। কেউ ঠিকঠাক করছে এখনো। পুবপাড়ার ক’টি আধাপাকা বাড়ি অক্ষত। ওগুলোর মধ্যে শিউলিদের একটি। শিউলি কি আছে! ছাগল নিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল— শিউলিরা এ বাড়িতেই থাকে। ‘খোদা-ভরসা’ লেখা গেটে টোকা দিলাম। কোনো শব্দ হলো না। কেমন একটা সুনসান নীরবতা। একটা জানালা খুলে গেলে কেউ একজন বলল :

— কে, কাকে খোঁজেন?

— শিউলিরা কী এখানে থাকে?

— থাকে, এখানেই আছে।

— আমি সবুজ, পশ্চিমপাড়ার সবুজ।

নাম বলতেই সশব্দে দরজা খুলে গেল। শিউলির মুখ। মাথায় ওড়নাটা পেঁচিয়ে দাঁত দিয়ে ধরা। কবিতাময় মেয়েটির মুখের মায়ায় নিজের ছায়া দেখলাম। ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, যুদ্ধে গিয়ে একটাও খবর দাওনি। বেঁচে আছ কি না তাও জানাওনি। গ্রামে কত কী হয়ে গেছে! তোমাদের বাড়ির কেউ বেঁচে নেই। রেবা আপাকে কোথায় নিয়ে গেছে, কেউ জানে না। আমাদের গুষ্টির কিছু হয়নি। মনে হয় কতদিন ঠিকমতো ভাত খাওনি। ভাত আছে। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বস। পরে কথা হবে।

আমি খেতে বসি। শীতল পাটি। পরিপাটি সাজানো ভাত তরকারি। চিকচিক করছে কাঁসার থালা। ‘মনে আছে শিউলি? তুমি চীনামাটির প্লেটের গল্প বলতে। আমি বলতাম কাঁসার থালার গল্প। আজ তুমি কাঁসার থালাতেই খেতে দিলে।’

‘এই তো দুদিন হলো আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল তো! চীনামাটির প্লেটসহ অনেক কিছু ভেঙে দিয়ে গেছে।’

ভাপ ওঠা ভাতগুলো নাড়তেই চিকচিক করা কাঁসার থালায় চোখে পড়ল খোদাই করা একটি নাম— ‘সুফিয়া খাতুন’। আমার দাদির নাম। আর খাওয়া হলো না। হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। ‘যাই। আর কখনো দেখা হবে না।’

‘কেন?’

উত্তর দেবার আবশ্যকতা বোধ করিনি । হনহন করে রাস্তায় নেমে পড়ি। নাড়িভুঁড়ি গুলিয়ে যেতে থাকে। খিদেয়, নাকি ঘৃণায়! 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads