• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

মুক্তিযুদ্ধের কবিতার নান্দনিক দিক

  • মজিদ মাহমুদ
  • প্রকাশিত ২৭ মার্চ ২০১৯

যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা মানুষের একটি আদি নান্দনিক প্রয়াশ। মানুষের সংগঠন-যুগের এমনকি অধুনিককালের মহাকাব্যের বিষয় ঘনীভূত হয়েছে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধের মাহাত্ম্য, বীরত্ব ও যুদ্ধের রীতিনীতিকে এসব কাব্যে মান্য করা হয়েছে। আবার কখনো বীরধর্ম বাৎসল্য ধর্মের কাছে পরাজিত হয়েছে। বাংলা কবিতাতেও আমরা কমবেশি এর ছিটে-ফোঁটা দেখতে পাই। তবে চর্যাপদের কবিরা আধা শিকার যুগের বাসিন্দা হলেও যোদ্ধা নন। মঙ্গলকাব্য কিংবা রোম্যান্টিক প্রণোপাখ্যানেও সে অর্থে যুদ্ধ নেই। তবে মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যানে পদ্মাবতীকাব্যে কিছুটা ঐতিহাসিক যুদ্ধের বর্ণনা আছে। পুঁথি ও প্রণোপাখ্যানেও ধর্ম ও ন্যায়যুদ্ধ আছে। অ্যাকিলিস হেক্টরের মতো ট্রয়বীরদের মতো এসব কাব্যেও বীরবন্দনা করা হয়েছে।

তবে বাংলা কবিতার প্রকৃত যুদ্ধের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়— মেঘনাদবধে। রামায়ণ-মহাভারত, প্রাচীন গ্রিক কিংবা মিল্টনের ঢঙে মাইকেল বাংলা কবিতার আর্দ্রভূমিতে যুদ্ধের আয়োজন করেছিলেন। মাইকেলকে অনুসরণ করে বাঙালি কবিরা এক যুদ্ধ-অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। রঙ্গলাল, নবীন, হেম, কায়কোবাদ— বেশকিছু যুদ্ধের কাব্যে লিখেছিলেন। তখন প্রকৃতই বাঙালির যুদ্ধের দরকার ছিল। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বাঙালি তখন প্রস্তুত হচ্ছে। এক অন্যায় সমরে বাঙালির নবাবকে হারিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ। সিপাহীদের পরাস্ত করেছিল। বাঙালি তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ আলাদা। ইতিহাসের আর কোনো আন্দোলন, যুদ্ধ ও সংগ্রামের সঙ্গে চূড়ান্ত বিচারে এর তুলনা হয় না। এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার চূড়ান্ত স্বাধিকার অর্জন করেছে। আর এই চূড়ান্ত-পর্বে আসার জন্য তার রয়েছে এক বিশাল প্রস্তুতিপর্ব। বাঙালি জাতির চিৎপ্রকর্ষে তাই মুক্তিযুদ্ধ বেড়ে উঠছিল দীর্ঘকালব্যাপী। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাঙালি কবির হূদয় গভীরভাবে আন্দোলিত হয়েছিল।

আধুনিককালে যুদ্ধের কবিতার ধারণাটি আসে মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। এ সময়ে বেশ কয়েকজন কবি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন। তারা কবিতায় তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন। যুদ্ধময়দানে ইংরেজ কবি হিসেবে রূপার্ট ব্রুক, আইজাক রোজেনবার্গ, উইলফ্রেড ওয়েন, চার্লস সোরলি বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। এ সময়ের যুদ্ধের কবিতাকে সৈনিক-কাব্য হিসেবেও উল্লেখ করা হতো। ঠিক একই সময়ে বাংলা কবিতায় এ ধারার কবিতা লিখে মাতিয়ে দিয়েছিলেন হাবীলদার কাজী নজরুল ইসলাম। করাচি ফেরতা বাঙালির এই কবি কামালপাশা, আনোয়ার পাশা কিংবা চল চল চল-এর মতো প্রভৃতি কবিতায় যুদ্ধ ময়দানের আবহ তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধরত সৈনিকদের নিযে রুডিয়ার্ড কিপলিংও কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

কিন্তু যুদ্ধের কবিতা যুদ্ধের উত্তেজক পরিস্থিতি ধারণ করে এমন নয়। যুদ্ধের কবিতার ক্ষেত্রে ডব্লিউ বি ইয়েটস একটি ভালো উদাহরণ হয়ে আছেন। আয়ারল্যান্ডের এই কবির কাছে স্বাধীনতার মানে জানা ছিল। তার দেশ এখনো সে সংকট পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারেনি। সুতরাং তিনি যখন বিদ্রোহী বোমাহত রাজপথকে ‘টেরিবল বিউটি’ হিসেবে বর্ণনা করেন, তখন আমরা তার অর্থ বুঝতে পারি। তিনি যখন লাল গোলাপের সৌন্দর্য বর্ণনা করেন; তিনি যখন বলেন, ‘রেড রোজ প্রুড রোজ, স্যাড রোজ অফ অল মাই ডেজ/কাম নেয়ার মি, হোয়াইল আই সিং দি আনসিয়েন্ট ওয়েজ।’ তখন আমরা গোলাপ, রক্ত, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আলাদা করতে পারি না। যুদ্ধের কবিতার ব্যাপারে তিনি বলেছেন, অন্তত সত্যের জন্য কবিদের মুখ এখন বন্ধ করতে হবে। সুতরাং, সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধের চেয়ে কবিতা বড় নয়।

যুদ্ধ এমন এক অনিবার্য বাস্তবতা। প্রতিমুহূর্তে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনায় মানুষ পরম এক সত্যের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। শান্তিকালীন অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধকালের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাই যুদ্ধের সৌন্দর্য বর্ণনায় কলাকৈবল্যবাদিতার স্থান নেই। একটি ধারণার সত্যকে রূপদান যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। হত্যা কিংবা সন্ত্রাস যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়। হত্যাকে চিরতরে পরাস্ত করা যুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য। যুদ্ধকালে যোদ্ধা কবিরা যেসব পারিপার্শ্বিকতার মধ্য থেকে কবিতা রচনা করেন তা-ই মূলত যুদ্ধের কবিতা। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লেখা যেকোনো সময়ের কবিতাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বললেও যুদ্ধকালে যোদ্ধা কবিতার সঙ্গে যার তুলনা হয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে কবিতাগুলো বেছে বের করা কঠিন। কারণ ওই সময়ে যেসব কবি মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে ছিলেন, তাদের পক্ষে কবিতা প্রকাশ সহজ ছিল না। তাছাড়া পরবর্তী সময়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা লিখেছেন; কিন্তু তাদের অনেকেরই রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা ছিল না। এক্ষেত্রে আহসান হাবীবের ‘সার্চ’ সিকান্দার আবু জাফরের ‘বাংলা ছাড়ো’, শামসুর রাহমানের ‘এখানে দরজা ছিল’ কবিতা স্মরণযোগ্য :

১. হল্ট বলেই হুঙ্কার ছেড়েই যম সামনে খাড়া

লোমশ কর্কশ হাত ঢুকে গেল প্যান্টের পকেট

কিছু পয়সা দুটি ফুল সুতোর বান্ডিল অতঃপর

ভারী হাতে কোমর জরিপ। কিছু নেই।

কুছ নেহি? বোমাওমা? সাচ্ সাচ্ বাতাও নেহিত...

 

যুদ্ধকালে এই বাংলাদেশ, এই রাজধানী ঢাকার চিত্র সবার জানা।

২. রক্ত চোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া

আমার বছরগুলো

কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি

কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে

কেউটে সাপের ঝাঁপি।

 

বাঙলা কবিতায় বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পরিধি ব্যাপক। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আগে এবং পরে প্রায় অর্ধশত বছর ধরে এ দেশের কবিরা মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতায় মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নযাত্রা প্রতিফলিত হলেও রণাঙ্গনের নয় মাসে রক্ত দিয়ে লেখা কবিতার সঙ্গে তার তুলনা হয় না।

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাকে কালের দিক দিয়ে তিন পর্যায়ে ফেলা যায়। ১. চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখিত কবিতা। ২. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিখিত কবিতা। ৩. মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে লিখিত কবিতা। বিষয়ের দিক দিয়েও এ কবিতাগুলোর বহুমাত্রিকতা রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে সাহিত্য বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নয়। কবি শব্দের মাধ্যমে তার অবিনশ্বর ধারণার জগৎ নির্মাণ করতে চান। কখনো একটি বা দুটি শব্দের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের ‘বস্তুর আকার’,  ‘জগন্নাথ হল’ ‘শূন্য পটভূমিতে শূন্যতার স্থির চিত্র’ ‘গেরিলা’ কিংবা আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘ঘাতক ১৯৫’ কবিতাটি। কবির কাজ পাঠকের চেতনালোকে ঘটনার অস্তিত্ব তুলে ধরা।

এ সময়ে লিখিত আল মাহমুদের ‘ক্যামোফ্লাজ’ কবিতাটি এখানে স্মরণযোগ্য। কবি টোটাল ধারণাকে একটি অস্তিত্ববাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। মানুষকে বেঁচে থাকতে হবে তার পরিবেশের বিবর্তনবাদের সঙ্গে। যে যুদ্ধ অনিবার্য সে যুদ্ধ প্রাকৃতিক। প্রকৃতির অনিবার্যতা থেকে কবি মুক্তিযুদ্ধকে আলাদা করে দেখেননি। প্রকৃতি ও উদ্ভিদবিদ্যার এমন সব ইঙ্গিত কবি এখানে তুলে ধরেছেন— যা বাঁচার যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

 

নিজেকে বাঁচাতে হলে পরে নাও হরিৎ পোশাক

সবুজ শাড়িটি পর ম্যাচ করে, প্রজাপতিরা যেমন

জন্ম-জন্মান্তর ধরে হয়ে থাকে পাতার মতন।

প্রাণের ওপরে আজ লতাগুল্ম পত্রগুচ্ছ ধরে

তোমাকে বাঁচতে হবে হতভম্ভ সন্ততি তোমার।

 

এ ছাড়া পঞ্চাশ দশকের কবিদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমানের স্মৃতি, তোমার আপন পতাকা, এখন সকল শব্দই, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, মানুষের স্বাধীনতা, কমলের চোখ, আর কত রক্ত দিতে হবে, সাইয়িদ আতিকুল্লাহর আরো একবার ভালোবেসে, তাও যদি কেউ দেখে, আতাউর রহমানের মা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের জার্নাল ১৯৭১, সহজে নয়, ঘৃণা-ক্রোধের বারুদ, সন্তোষগুপ্তের ফেরারি স্বদেশ, আহমদ রফিকের এ দেশ আমার স্বর্গ, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছবি, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মঞ্চে দেখা দাও, অপরাজেয়, আলাউদ্দিন আল-আজাদের স্বাধীনতা ওগো স্বাধীনতা জুলফিকার মতিনের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, ফজল শাহবুদ্দিনের এপ্রিলের একটি দিন ১৯৭১, বাংলাদেশ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাকে, নবান্ন ১৩৭৬, আবুবকর সিদ্দিকের শপথের স্বর, শহীদ কাদরীর নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায় ওমর আলীর স্বদেশে ফিরছি, বেলাল চৌধুরীর স্বদেশভূমি, মর্মে মর্মে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য।

ষাটের কবিদের অনেকেই সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই তাদের কবিতায় প্রত্যক্ষ বারুদের গন্ধ ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণ শোনা যায়। ষাটের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ কবিতাটি ঠিক এমন : ‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা করলাম/বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে/ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে/টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালী স্বপ্নকে।’ নির্মলেন্দু গুণের আগ্নেয়াস্ত্র কবিতা থেকে : ‘আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি/কোমল বিদ্রোহী— প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে ঘরে/অথচ আমার সঙ্গে/হূদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র/আমি জমা দিইনি।’

মাহবুব সাদিকের যুদ্ধভাসান কবিতার মধ্যে রয়েছে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। কবি যেখানেই যান সখিপুর তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। হাটফেরা অছিরুদ্দিনের ছিন্নভিন্ন লাশ, গারো রমণীর ভালোবাসা, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস কবির কাছে সখীপুরের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়— ‘খুব বেশি দূরে নয় সখীপুর/শহর ছাড়লে গ্রাম, তারপর গ্রাম, তারপর/পাহাড়ের জানু ছুঁয়ে লাঙলের মতো বাঁকা নদী/তারপর সবুজ যুদ্ধভূমি সখীপুর.../কি করে ভুলব তাকে/যেখানেই যাই সখীপুর সঙ্গে সঙ্গে থাকে’।

এ সময়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, আল মুজাহিদী, বুলবুল খান মাহবুব, সিকদার আমিনুল হক, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব আহসান চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, আবু কায়সার, ফরহাদ মজহার, খালেদা এদিব চৌধুরী, সমুদ্র গুপ্ত, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হেলাল হাফিজ, অসীম সাহা, মাকিদ হায়দার, অরুণাভ সরকার, শামসুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, জাহিদুল হক, আলতাফ হোসেনসহ অনেক কবিই তখন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন।

ষাটের পরে মূলত সত্তর দশকের কবিরাই প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম। সাদা কাগজ আর শত্রুর বিরুদ্ধে তারা একই সঙ্গে কলম আর বন্দুক ধারণ করেছিলেন। বুকের রক্ত আর কলমের কালি তাদের কাছে সমার্থক ছিল। তারা ছিলেন ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের সন্তান। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা আর তারুণ্যের তরতাজা আগুন তাদের কবিতাকে দিয়েছিল একই সঙ্গে দ্রোহ ও টিকে থাকার ক্ষমতা। নান্দনিক বিচারে যা ছিল তাদের কবিতার দুর্বল দিক তা-ই কালের বিচারে কালোত্তীর্ণ বিষয় সৌন্দর্য নিয়ে টিকে থাকবে বহুকাল। এ সময়ের কবিদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার কিছু উজ্জ্বল পিক্ত :

১. ক্রোধের জন্য ক্রোধ নয়? আমি যুদ্ধ করেছিলাম ভালোবাসার জন্য  (গ্রেনেড : আবিদ আজাদ)

২. খুব মনে পড়ে নজরুলকে ডিসেম্বর মাসে (নজরুলকে মনে পড়ে : শিহাব সরকার)

৩. প্রত্যেক পালকে আছে বন্ধনহীন মেঘের স্বাধীনতা (খোলা জানালার দিন : জাহিদ হায়দার)

৪. যুদ্ধ মিছিলে মৃত্যু বারুদে মাখা/সেই মুখখানি কবিতার বড় ছিল  (সেই মুখখানি স্বাধীনতা প্রিয় ছিল : কামাল চৌধুরী)

৫. বিজয়ের বোন দরজায় কড়া নাড়ে (বিজয়ের বোন কড়া নেড়ে যায় : নাসির আহমেদ)

৬. বিপন্ন এশিয়ার বুকে ধুঁকে মরছে পৃথিবীর কনিষ্ঠ সন্তান (বাংলাদেশ : সোহরাব হাসান)

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে একটি বাঁক-বিপ্লব। যেকোনো সময়ের কবিতা থেকে তা আলাদা করে চেনা যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা, জীবন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, রণাঙ্গনের চিত্র, তৎকালীন ব্যবহার্য মারণাস্ত্র এই সময়ের কবিতার অঙ্গ গঠনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এ সময়ের শব্দ ও বাকপ্রতিম, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ ও ছন্দপতন বাংলা কবিতাকে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

যেকোনো কবিতা কবির দায় নয় আনন্দ। প্রকৃত কবি কবিতার মাধ্যমে তার সত্যের মুখোমুখি হন। এক্সটার্নাল রিয়ালিটির অবসান ঘটলেও কবির ইন্টারনাল রিয়ালিটি নতুন সত্যের দিকে ধাবিত হয়। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ আজ ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু বাঙালি কবিরা যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যতে পরিণত করেছিলেন। তার জাতির আবেগকে ভাষায় গেঁথে তুলেছিলেন। যার স্পন্দন আজকের পাঠকও স্পষ্ট শুনতে পায়। যেকোনোকালে মুক্তিযুদ্ধের কবিতার এই পরিবাহিতা-ই তার সম্যক দর্শন— তার নান্দনিকতার প্রকাশ। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads