• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ত্রি-মহাদেশীয় বসন্ত ও কাব্যে তার রূপ

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

ত্রি-মহাদেশীয় বসন্ত ও কাব্যে তার রূপ

প্রাসঙ্গিকী ও বাঙলায়ন

  • মীম মিজান
  • প্রকাশিত ৩০ মার্চ ২০১৯

প্রকৃতি আমাদের বিচরণক্ষেত্র। আমাদের এ বিচরণে দেখি প্রকৃতির প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ। জ্ঞানবান প্রত্যেকটি মানুষই নানাভাবে প্রভাবিত হই প্রকৃতির পালাবদলে। আর যারা চিন্তাশীল ও শিল্পমানস তাদের কাছে এই প্রকৃতি এক অনুপম ক্ষেত্র। প্রকৃতির সামান্য একটু বিষয়ও ভাবিয়ে তোলে শিল্পমানসদের। একই প্রকৃতি যা সাধারণ মানুষ দেখে আর সৃজনশীল মানস দেখে। উভয় দেখার মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। সাধারণ মানুষ যা বলে আর সৃজনশীল মানস যা বলে— উভয় বলার মধ্যেও বিস্তর ফারাক। একটি দর্শন ও প্রকাশ মামুলি। পক্ষান্তরে অপরটি নান্দনিক ও মনোহর।
সময় এখন বসন্তকাল। ঋতুদের রানী এই বসন্তের আবহাওয়া আজ আমাদের মাতিয়ে রেখেছে। তার নানা ধরনের ফুল, ফল, পাখির ডাক, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের মনকেও করেছে উৎফুল্ল। যুগে যুগে কালে কালে এই ঋতুরাজ বসন্ত সাহিত্যের বিশাল এক অনুষঙ্গ হয়ে এসে কবি-সাহিত্যিকদের মননের নান্দনিক প্রভায় ছত্রে ছত্রে মূর্ত হয়েছে। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যময় এ ধরার নানা দেশ ও অঞ্চলে নানা অনুষঙ্গ দিয়ে বছর শুরু ও শেষ হয়। আমাদের এখানে বছর শেষ হয় বসন্ত দিয়ে। অন্যান্য দেশে আবার বসন্ত দিয়েই প্রারম্ভ হয় বছরের। শীত শেষ হলে যেখানে আমরা বাংলা সংস্কৃতির লোকজন বসন্ত পাই সেখানে অনেক দেশে বসন্তের পর শীত ঋতুর আগমন ঘটে।
তবে বসন্তের যে রূপ-আবহ কবিতা-গল্পে পরিলক্ষিত হয় তার কতখানি বাস্তবতার সাথে মিল আছে তা আমরা একবার সরেজমিনে দেশের মাটিতে ঘুরলে উপলব্ধি করতে পারব। যে ধরনের কালার্ড ইমেজ আমরা কাব্যে ও গদ্যে দেখি সে ধরনের কালার্ড ইমেজ বাস্তবে কতটুকু আছে দেশে? ইরির খেতে এখন ছলবল পানিতে দাঁড়িয়ে কিশোর চারা। কৃষ্ণচূড়া দেখি ডালে ডালে। রাতুল শিমুল ফুলে বিহানবেলা বসে পাখিদের আসর। আমের মুকুলের মৌ মৌ সুবাস। কাঁঠালগাছে সবুজ সবুজ কুঁড়ি। মাঝে মাঝে আকাশ কেঁদে রাতে বাড়িয়ে দেয় নকশিকাঁথার প্রয়োজনীয়তা। বিল শুকিয়ে চৌচির। বাঁশবাগানে দেখি নেড়ে বাঁশের সমাবেশ। নিচে স্তরে স্তরে পড়ে থাকে প্রাণহীন পাতা। পুকুর বা বিলের মতোই চির ধরে আমাদের ত্বকে। রাস্তার পাশের বাড়িঘর, গাছপালা, প্রকৃতি ঢেকে যায় অমূল্য ধূলোর স্তরে। বসন্তের যে উচ্ছ্বাসময় উপস্থিতি আমাদের সাহিত্যে তার বেশিরভাগ বোধহয় ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে আগত। আমাদের প্রকৃতির মূল উপস্থিতি আজ অনেকটা দাবি করে।
ইউরোপের সঙ্গে সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটা যোগাযোগ আছে আমাদের। কবিতার নানা বিষয়, উপন্যাস, ছোটগল্প ইত্যাদির ধারা আমরা সেখান থেকেই গ্রহণ করেছি। ফারসি সাহিত্য আমাদের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করেছে যে আমাদের ভাষায় ব্যবহূত বিদেশি অনেক শব্দই ফারসি। ইরানের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফারসি আমাদের এ দেশে একসময় সাড়ে সাতশ বছর রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল। ফলে তার প্রভাবও আছে। ইরানে বসন্ত দিয়েই শুরু হয় বছর। আর এজন্য দীর্ঘ পনেরো দিনব্যাপী থাকে সরকারি আয়োজন ও ছুটি। এরকম উৎসব আর কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। সাজ সাজ রব আর নতুন পোশাকে সবাই উদ্বেল থাকে।
ইউরোপীয় সংস্কৃতির বসন্ত; কাব্যে সেই বসন্তের আঙ্গিক রূপায়ণ কিরূপ ইত্যাদি জানার অভিপ্রায়ে ইউরোপের একজন কবির কাব্যের অনুবাদ ও আমেরিকার বসন্তের আবহ জানার জন্য মার্কিনি একজন কবির কাব্যের রূপান্তর এখানে উল্লেখ করা হলো। পাশাপাশি ঐতিহ্যের লীলাভূমি ইরানের একটি চমৎকার কবিতার বাঙলায়নও রয়েছে। ইংরেজি কবিতা দুটো পোয়েম হান্টার আর ফারসি কবিতাটি সেতারেহ ডটকম থেকে সংগৃহীত।
প্রথমে যাঁর কবিতা স্থান পেয়েছে তিনি হচ্ছেন পোয়েট অ্যান্ড পেইন্টার নামে খ্যাত উইলিয়াম ব্লেক (২৮ নভেম্বর ১৭৫৭ - ১২ আগস্ট ১৮২৭)। রোমান্টিক যুগের একজন উজ্জ্বল কবি যিনি ভিজ্যুয়াল শিল্পে প্রখ্যাত। সিম্বোলিক ধাঁচের এই কবির কাব্যে প্রকৃতি দারুণভাবে ফুটে উঠত। ইংল্যান্ডে জন্ম নিলেও তাঁর কাব্য এখন সারা বিশ্বময়। দ্বিতীয়জন হলেন এমিলি ডিকসন (১০ ডিসেম্বর ১৮৩০ - ১৫ মে ১৮৮৬) মার্কিন সাহিত্যের একজন রুচিশীল কবি। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এক সংস্কৃতিবান পরিবারে। তিনি অবিবাহিতা থেকে সফেদ পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত ছিলেন। তার ১৮০০-এর বেশি কবিতা পাঠককুলকে রসাস্বাদন করাচ্ছে। ইরানি বসন্তের পরস্ফুিটন যে কবিতায় তার কবি ফারিদুন ম’শিরি (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ - ২৪ অক্টোবর, ২০০০)। ফারসি প্রখ্যাত এই কবি আধুনিক ও ক্লাসিক উভয় রীতিতে কাব্য রচনায় সমান পারঙ্গম।

 

উইলিয়াম ব্লেক
বসন্তের প্রতি

হে শিশিরজলকপাটসহ তুমি, কে নিচে তাকিয়েছে
বিহানবেলার স্বচ্ছ বাতায়ন দিয়ে,
ঘুরাও তোমার স্বর্গীয় নেত্র আমাদের পশ্চিমা দ্বীপের উপর,
যাতে পূর্ণাঙ্গ বাদকদল আপনার অভিব্যক্তিকে উদযাপন করছে, হে বসন্ত!

পাহাড়গুলি একে অপরকে বলছে, আর উপত্যকা থেকে শ্রবণ করা যাচ্ছে তা;
আমাদের সকল আকাঙ্ক্ষিত চোখ চেয়ে আছে উজ্জ্বল শিবির পর্যন্ত :
ঘটনা আসন্ন আর আপনার পূত চরণকে আমাদের আবহাওয়া প্রদক্ষিণ করতে দিন!

পুবের পাহাড়গুলোর উপর দিয়ে আসুন, আর আমাদের সমীরণকে
আপনার সুগন্ধযুক্ত পরিচ্ছদকে চুম্বন করতে দিন,
আপনার প্রভাতের ও বিকেলের স্বাদ আমাদের নিতে দিন;
আমাদের প্রেমভূমির উপর আপনার মুক্তোদানা ছড়িয়ে দিন যা আপনার তরে শোক।

হে পাটাতন, তার আহ্বান আপনার সুন্দর অঙ্গুলি দিয়ে;
তার হূদে আপনার কোমল চুম্বন বর্ষণ করুন;
তার বিষণ্ন মাথায় আপনার মুকুটটি পরিয়ে দিন
যার বিনয়ী বিনুনি আপনার জন্যই নির্ধারিত।

এমিলি ডিকসন
বসন্তে বর্তমান এক জ্যোতি

বসন্তে বর্তমান এক জ্যোতি
যা এখন গন্ধবহে নেই
অন্য কোন মুহূর্তে।
এখানে মঙ্গলগ্রহ যখন ক্বচিৎ

এক বরণ দাঁড়িয়ে
সঙ্গিহীন পাহাড়ের বহিরাংশে
বিজ্ঞান যা অতিক্রান্ত করতে পারে না,
কিন্তু মানব স্বভাব তা অনুভব করে।

এটা বনভূমির উপর অপেক্ষারত;
এটা সবথেকে দূরের বৃক্ষকে দেখাচ্ছে
আমার জ্ঞাত ঢালুর উপর;
এটা প্রায়ই আমাদের সাথে কথা বলে।

অতঃপর, দিগন্তের পদক্ষেপের ন্যায়,
অথবা শশীর বাইরের খবরের ন্যায়,
ধ্বনির নিয়ম ব্যতিরেকে,
এটা অতিক্রান্ত, আর আমরা রয়ে গেছি:

এক প্রকার লোকসান
আমাদের বিষয়বস্তুকে সংক্রমিত করেছে,
যেমন ব্যবসাপাতি হঠাৎই বেদখল হয়ে যায়
সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে।

 

ফারিদুন ম’শিরি
বসন্তে আস্থা রাখো

বাতায়নগুলো খুলে দাও
সুহূদ শীতলা বাতাসের জন্য
যাতে সুন্দরম প্রসূনগুলির জন্মদিন উদযাপিত হবে
আর বসন্তের উৎসবের জন্য
প্রত্যেক শাখায় শাখায়,
চমৎকার মোমবাতি প্রজ্বলিত হয়েছে!

সব পরিযায়ী ফিরে এসেছে
সজীবতার নান্দনিক গীত গাচ্ছে
আমাদের আঁটসাঁট রাস্তা বাসন্তিক গীতে পূর্ণ
চেরি গাছগুলি
সবগুলিই প্রস্ফুটিত
প্রত্যেক প্রসূনের জন্মদিন উদযাপনের জন্য

সখা মোর, বাতায়নটি খোলো!
তোমার কি কখনো মনে পড়েছে?
একটি বন্য তৃষ্ণা আমাদের অবনিকে পুড়িয়েছিলো
আর সকল পল্লব ম্লান হয়েছিলো?
তোমার কি মনে আছে
মন্দ তৃষ্ণাটি কি মৃত্তিকার যকৃতের সাথে ছিলো?

তোমার কি কখনো স্মরণ হয়েছিলো
মন্দ শীতলতার হাত কি আমাদের দ্রাক্ষালতার সাথে ছিলো?
আর নিঠুর শীতলা বাতাস কি আমাদের পুষ্পের সাথে ছিলো
আঁধার সেই শর্বরীর মাঝপথে?

তুমি কি কখনো সেটা মনে করেছ?
এখন বৃষ্টির অলৌকিকতার ওপর আস্থা রাখো
আর মহত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি দাও
সবুজ তৃণভূমির মধ্যের আঁখি দিয়ে
আর দেখো স্নেহাশিস
শুভাকাঙ্ক্ষী মৃদু সমীরণের হ্রদে
সেটাই তার নিঃস্বতা,
যুবা প্রসূনের জন্মতিথি উদযাপনে কি?

মৃত্তিকা আবার প্রাণবন্ত হলো
কেন তুমি নিস্তব্ধ শিলায় পরিণত হয়েছো?
কেন তুমি অনেক হতাশাগ্রস্থ?
বাতায়নটি খোলো
আর বসন্তের ওপর আস্থা রাখো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads