• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
ময়নাপাগল ও অলৌকিকতার লোকাচার

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

ময়নাপাগল ও অলৌকিকতার লোকাচার

  • বঙ্গ রাখাল
  • প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল ২০১৯

মানুষ তার সমাজ বা জীবনযাপনের প্রয়োজনে যে বিধিনিষেধ বা আচার শৃঙ্খলা মেনে চলে, তা-ই ধর্ম বা ধর্মাচার। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ— এই চারটি এদেশের মানুষের জীবনচর্চার প্রধান ধর্ম হলেও উল্লেখ থাকে যে এসব ধর্মের কোনোটিই এদেশের মাটিতে উদ্ভাবিত নয়। এই প্রধান ধর্মমতের পাশাপাশি এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মমত গড়ে উঠেছে। মুখ্য ধর্মমতের পাশাপাশি এই গৌণ ধর্মমতগুলোর পরিচয় মূলত লৌকিক ধর্ম হিসেবে। এ ধর্মের মানুষেরা সব সময় নিজেদের শাস্ত্রীয় নিয়মরীতি থেকে দূরে রেখেছে। এ ধর্ম একদিকে যেমন সমন্বয়বাদী তেমনি অন্যদিকে প্রতিবাদী, চেতনাবাদী। তবে এই ধর্মমত শাস্ত্রীয় ধর্মমতের চাপে নিজেদের অন্তর্মুখিতা থেকে বের করে আনতে পারে না। এ জন্যই এই মতাদর্শীদের অবস্থান হয়ে থাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের মধ্যে।

সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময় দেশগত, জাতিগত বা শ্রেণিগত নানা বিভেদ দেখা দিয়েছে আর এসব বিভেদ থেকেই ধর্মের আওতাভুক্ত হয়েছে কিছু দেশাচার বা লোকাচার যা বিভিন্নভাবে ধর্মকে প্রভাবিত করেছে। লোকাচার হলো তা-ই, যা যুগে যুগে ধর্মাদি সংস্কারের মানসে যে মিশ্র লৌকিক ধর্মমতের আবির্ভাব হয়েছে বা হতে বাধ্য হয়েছে তাকেই লোকধর্ম বলে (লোকাচার লোকধর্মই আন্তরধর্ম : সহিনুর খাতুন)। আসলে তুর্কি-পরবর্তী নব্য বাঙালি মুসলমান সমাজ কখনোই মূল কোরআন (আরবি ভাষায় রচিত) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরং তারা পীর, সুফি, দরবেশ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। ফলত ইসলামের আদর্শ, ত্যাগ, সেবা, ন্যায়নিষ্ঠা, পরোপকার এসবের তুলনায় বাহ্যিক আচার-আচরণ, কবচ-তাবিজ ধারণ, মানত করা, ঝাড়ফুঁক, পীর-ফকির-সুফি দরবেশ ওলি-আউলিয়ার দরগায় চাদর চড়ানো, তেল-শিন্নি দেওয়া, সাঁঝ দেওয়া, ধূপ জ্বালানো— এসব লৌকিক ধর্মাবেগকেই স্বীকার করে নিয়ে মেনে চলত। ধর্মের শাস্ত্রীয় দিক যতটা না গুরুত্ব পেয়েছিল, তার থেকে গুরুত্ব পেয়েছিল এই লোকাচার কবলিত লোকধর্ম। একুশ শতকেও এসে এ কথা সত্য।

তবে সাম্প্রতিক শিক্ষিত নাগরিক মুসলমানদের মধ্যে শরিয়তি বিধিবিধান বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত নিরক্ষর অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গের মানুষেরা লোকাচার কবলিত লোকধর্মের প্রতি বেশ আগ্রহী। আর এই লোকাচারই আমাদের সংস্কৃতির বিশাল অংশ হিসেবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে যা থেকে আমরা ইচ্ছা করলেই বের হয়ে আসতে পারি না। যে কারণে একজন শরিয়তপন্থি হয়েও কোনো না কোনোভাবে লোকাচারের অনুষঙ্গগুলো উপস্থাপন করে থাকে।

‘মানব অভিযাত্রার সবচেয়ে বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পটভূমি হলো তার সংস্কৃতি। বলা যায় লোকসংস্কৃতিই মানুষের সৃজনপ্রতিভা বিকাশের নিয়ামক আকর। আজকের যে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা, তার সূচনাকাল বৃহত্তম গ্রামীণ সমাজেই হয়েছিল। আমরা জানি সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের চিন্তাশীলতার সূতিকাগার। মানুষ যা কিছুই সৃষ্টি করে তা-ই সংস্কৃতি’— একথা নৃবিজ্ঞানী ম্যানচিপ হোয়াইটের। মানুষই তার সংস্কৃতিকে সৃজন করে এবং তা হাজার বছর ধরে হূদয়ে ধারণ করে। সংস্কৃতিকে হঠাৎ করেই একদিনে ভুলে যাওয়া বা নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, তবে এটাকে আবার মানুষ বশ মানিয়ে নিজেদেরও বদল ঘটাচ্ছে। মানুষ নিজেদের তাগিদেই মান্ধাতার আমল থেকেই নিজেদের বের করে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করে তুলছে। যদিও এটা কোনো নতুন সংস্কৃতি নয়। সেই পুরাতন সংস্কৃতিকেই কোনো না কোনোভাবে নতুনিকরণ করে আমাদের সামনে আলাদা করে উপস্থাপন করছে আর আমরা আধুনিকতার নাম না করে সবকিছু ভুলে নতুনের পিছু নিচ্ছি। ফোকলোর বা সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের বিখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ ড. মযহারুল ইসলাম চার ভাগে ভাগ করেছেন। এরই একটি ভাগ লোকাচার- লোকানুষ্ঠান। তিনি লোকাচার আর লোকানুষ্ঠান নিয়ে যে বিষয়াদি বোঝাতে চেয়েছেন, আমার লেখার মূল বিষয় সেখানেই। লোকাচার বা লোকানুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ‘লোকবিশ্বাস’।

লোকাচার বলতে আমরা বুঝি মানুষের লোকবিশ্বাস, অনুষ্ঠান, সংস্কার, শাস্ত্রীয় রীতিনীতি, লোকোৎসব, ঐতিহ্যিক ক্রিয়াকর্ম। প্রাচীনকাল ধরেই আমাদের মধ্যে এক ধরনের লোকবিশ্বাস চলে আসছে, যা মাজারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ২ নং মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি লোকসাহিত্যের উর্বরভূমি গোলকনগর গ্রাম। যে গ্রামে একসময় গড়ে উঠেছিল লালনের আখড়াবাড়ি। গ্রামের কিছু মানুষের অত্যাচারে সাধু-ফকিররা এই আখড়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ওপর অভিযোগ আনা হয়েছিল তারা নারীদের নিয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। এ গ্রামে জন্মেছিলেন— নূর মোহাম্মদ বিশ্বাস, ধূয়াজারী গায়েন মকবুল জোয়ার্দার, আনারুদ্দিন, আফজাল। যাদের মধ্যে আনারুদ্দিন আজো জীবিত রয়েছেন। গীতিকার হাসানুজ্জামানও এ গ্রামেরই সন্তান। যিনি একজন নিভৃতচারী কবি ও গীতিকার।
এই গ্রামেরই সন্তান ছিলেন ময়েন উদ্দিন (জ. ১৯৩৯ — মৃ. ২০১৬)। যাকে সবাই পরবর্তীকালে ময়নাপাগল হিসেবে চিনেছে। তিনি ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে এবং মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। কিন্তু জীবনের বাঁক কখন কার কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা তো আমরা বলতে পারি না। ময়নারও জীবনে নেমে আসে এক পরিবর্তনের ঋতু। আচরণগত দিক থেকে আমরা তাকে বলি পাগল।
সবার সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা, ক্ষুধা পেলে খাবে অথচ বাবার ঘরবাড়ি থাকলেও এই ঘরবাড়ির প্রতি তার কোনো লোভ-লালসা নেই। পরিধানে লুঙ্গি আর কাঁধে কম্বল ভাঁজ করে খালি পায়ে লাঠি হাতে বসে থাকেন রাস্তায়। যাদের চেনেন তাদের সঙ্গে কথা বলেন আর যাদের চেনেন না তাদের সঙ্গেও কথা বলে নেন। কত শীত পার করেছেন ৭৭ বছরের ময়নাপাগল এই খালি গায়ে এবং খালি পায়ে! লাঠি একমাত্র সম্বল তার। ময়নাপাগলের শিষ্যদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এই শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খোয়াজ গাজী বা খোয়াজ পাগলা, রিপন, চতুর আলী, হাবিব, খয়েজ, আদিল বিশ্বাস, শাখা মণ্ডল, আলফা মণ্ডল, আলকুম, শাহানূর কাজী, মীরজান, সাহেব আলী, রজব মণ্ডল, জামাল মণ্ডল, মোতাহার, কালু মণ্ডল, ফোয়াজ, মমতাজসহ নাম না জানা আরো অনেকে। অনেকে তাকে একজন আরোগ্য কর্তা হিসেবে ভেবে এসে পড়ে থেকেছে পা ধরে এবং তিনি তাকে পিটিয়েছেনও। পরবর্তী সময়ে অনেক রোগী আরোগ্য হয়ে গেছে এমন আরো অনেক প্রমাণই মিলবে তার শিষ্যদের কাছে। ময়নাপাগলের অলৌকিকতা সম্পর্কে জানা যায় তিনি যখন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, তখন তার বাড়ির লোকজন ভেবেছিল তাকে পাবনার পাগলা গারদেই রাখা শ্রেয় এবং তারা তাকে নিয়ে রেখেও এসেছিল। কিন্তু অবাক কাণ্ড হলো, যারা তাকে রেখে এসেছিল তারা বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই ময়না বাড়িতে এসে বসে ছিল। মাঝে মাঝে তিনি খালি মাঠের মধ্যে হেঁটে চলেছেন লাঠি হাতে আর কার সঙ্গে যেন নিভৃতে কথা বলতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কথায় কথায় বলেন ‘মিরাজ’। এই মিরাজই যেন তার সেই পরম সত্তা। যাকে আশ্রয় করেই তিনি বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়ে থাকেন। তার প্রেমেই তিনি মত্ত হয়ে ভুলে গেছেন ঘর-সংসার, স্ত্রী-কন্যা, জমি-জিরাত, ভাই ও বোনের সম্পর্ক।

সুফিতত্ত্বে দেখা যায় খোদার সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আর সেই খোদার প্রেমে দেওয়ানা হলেই তার আর অন্যকিছুর সন্ধান লাগে না— যাকে বলে পবিত্র আত্মা। এজন্যই এই সাধনাকে ‘হামাওস্য’ অর্থাৎ যা কিছু তিনি সবকিছুই আমি বলেই অভিহিত করা হয়। সবাই একসময় পাগল বললেও আজ যে তিনি একজন পবিত্র আত্মার মানুষ হিসেবে সমধিক পরিচিত এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এই ময়নাকে কেন্দ্র করে অজস্র অলৌকিক কাহিনি গীত আজ তার শিষ্যদের মুখে মুখে ফিরছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads