• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

শব্দবোমা

  • শিরিন আক্তার
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৯

প্রাচীরঘেরা বস্তিটিতে পনের বিশটি খুপরিঘর। মাঝখানে বড় উঠোন। তারই মাঝখানে শেষ বিকেলে বস্তির লোকজন গোল হয়ে বসেছে। সারাদিনের কাজের ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও কারো চোখেমুখে নেই। বস্তিময় উৎসবের আমেজ। কেবল নীলার চোখ দুটো ছলছল করে। উঠোনের এক কোণে বসেছে সে। তাকে ঘিরে তার ছেলেমেয়েরা কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোলের ছেলেটা আঁচলের নিচ থেকে মুখ বের করলেই নীলা ওর পাছায় আস্তে করে দু-আঙুল দিয়ে মোচড় দেয়। পাঁচটি ছেলেপুলের মা হয়েছে নীলা, অথচ শরীর গতরে ভাঙনের খবর নেই। তেমনি তার তেজ। এ বাসা থেকে ওই বাসা দাবড়ে বেড়ায়। কোনো কাজই যেন ওর গায়ে লাগে না।

বস্তির অন্যদের সঙ্গে অদ্ভূতভাবে নিজের একটি দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে সে। নীলার বাপের বাড়ির অবস্থাও মন্দ নয়। নিজের বাড়িতে থাকে তারা। কম হলেও জমিজমা আছে, ঘরের ভাত খায়। নীলা কিছুটা পড়ালেখা করেছে বলে আত্মসম্মান বোধটুকুওু আছে। নিজের অভাব অনটনের কথা বলে বেড়াতে পারে না। বস্তির আর পাঁচজনের মতো চলতেও পারে না। ছেলেমেয়েগুলোকে কাজে না দিয়ে স্কুলে পাঠায়। সন্ধ্যার পর নিজে পড়াতে বসায়। আড়ালে সবাই নীলার দেমাগ নিয়ে সমালোচনা করলেও, সামনাসামনি ওকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না। কলপাড়ে গোসল করে ঘরের ভেতর এসে সে ভেজা শাড়ি পাল্টায়। এ নিয়েও বস্তির মহিলারা টিটকারী মারে। বস্তির মালিক মাসে দু’একবার আসে। নীলা উঁকি দিয়েও দেখে না তাকে।

আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নীলা আজ করুণ মুখে বসে আছে। ওর স্বামী বিচার ডেকেছে। নীলাকে বাগে আনতে না পেরে শেষতক দশজনের আশ্রয় নিয়েছে ওর স্বামী। সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়। নীলা তাতে সায় দেয় না। দ্বিতীয় বিয়ে মানেই তো সংসার ছারখার। পাঁচ ছেলেমেয়েকে খাওয়াতে পরাতেই নীলা হিমশিম খায়। একজন মুরব্বি গোছের লোক নীলার স্বামীর অভিযোগ শুনতে চায়। নীলার স্বামী বলে, তার দ্বিতীয় বিয়ে করা দরকার। কিন্তু তার বউ এ নিয়ে রোজ রোজ ঝামেলা করে।

সালিশের সবাই এক বাক্যে নীলার স্বামীর পক্ষ নেয়। পুরুষ মানুষ বিয়ে করা দরকার মনে করলে করবে। এতে আদেশ-নিষেধের কী আছে? মহিলাদের মুখেও বিদ্রূপের হাসি। কেউ কেউ বলে, হের যে দেমাগ। হতীন লইয়া হে খাইবো? নারী-জীবনে এর চাইতে কঠিন সময় আর কী হতে পারে! সব তেজ নিমিষেই হাওয়া। নীলার অসহায়ত্ব কাউকে স্পর্শ করে না মোটেও। অন্যের পীড়ন দেখে এত সুখ পায় মানুষ! আজ সবাই তৃপ্ত। এবার কেউ কেউ নীলার দিকে তাকিয়ে বলে, হে বিয়া করলে তুমার অসুবিতা কী কও দেহি, শুনি আমরা।

নীলা বলে, আমার দুষ কিতা?

এ ওর মুখের দিকে তাকায়। নীলা ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে। স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। হাতের লাঠিটি উঠোনে লম্বা করে শুইয়ে রেখেছে সে। পাহাড়ে মাঠি কাটতে গিয়ে এক পা কেটে ফেলেছিল। ঠিক মতো চিকিৎসা করেনি। সেই থেকে খুঁড়িয়ে হাঁটে। কাজকামও তেমন করতে পারে না। নীলাই সংসারের হাল ধরে রেখেছে। তাই তো নীলাকে বরাবরই সে একটু সমঝে চলে।

নীলার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর পায় না। নীলা আবার বলে, আমার দুষ কিতা কইতে কন উনারে। ওর কণ্ঠের জোর আর স্পষ্টতায় ফিসফিস আলাপ বন্ধ হয়ে যায়। এক লোক নীলার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, কও তুমি।

নীলার স্বামী মিনমিন করে বলে, ওরে আর রুচি হয় না অখন। পাঁচ বাইচ্চার মা অইছে, আর কত?

এই কথা শোনার পর মহিলারা ব্যাঙ্গ করে বলে, তয় বেটি আর কিয়ের দেমাগ দেখায়? সবার অট্টহাসিতে উঠোন কেঁপে ওঠে। নীলার চোখ ঠিকরে আগুন বেরোয়। টান দিয়ে ছেলেকে উঠোনে বসিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচিয়ে চিৎকার করে বলে, ওই শূয়োরের বাচ্চারা, রুচি কি তোগো একলাই বদলায়? আমগো রুচি বদলায় না? লুলার লগে গর করতে আমার বুজি রুচি অয়? অয় না। আমার রুচি অয় না। আমি কি করমু হেইডা তোরা মিমাংসা কর আগে। আমি তারে ছাড়ন দিমু কইলাম।

নীলার স্বামী চমকে উঠে। বলে, এইডা কী কইলি তুই?

নীলার কথার জবাব দেয়ার সহাস পায় না কেউ। ধীরে ধীরে আসর ভাঙে। এক পা, দু পা করে যে যার খুপরির দিকে এগিয়ে যায়।

নীলা দৌড়ে ঘরে ঢুকে। ওর স্বামী উঠোনে একলা দাঁড়িয়ে থাকে কিছু সময়। ভেতর থেকে নীলার গগণবিদারী কান্নার আওয়াজ শুনে সে ভড়কে যায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে ঘরের ভেতর যায়। তারপর নীলার হাত ধরে বলে, বুজছি তরে আমি অসম্মান করছি। আর কমু না, ক্ষেমা দে বউ।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads