• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

মজিদ মাহমুদ

সীমাহীন যাত্রার নায়ক

  • শারমিনুর নাহার
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৯

কবি মজিদ মাহমুদের পাণ্ডিত্য, প্রতিভা বোধকরি সবারই কমবেশি জানা। আশিক দশকের কবিদের মধ্যে তার কবিতার স্বাতন্ত্রিকতা, ঔজ্জ্বল্য যেমন সর্বজনবিদিত তেমনি তার গদ্য বিশেষত ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘কমপারেটিভ লিটারেচার’ তার মূল্য কোনো অংশে কম নয়। কবিতার প্রসঙ্গকে ঊর্ধ্বে রাখলেও তার উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, অনুবাদ এবং গবেষণামূলক লেখাও আলোচনার দাবি রাখে।

আমি প্রথম তাকে চিনেছি তার গবেষণা গ্রন্থ ‘নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’ দিয়ে। তার সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুবাদে দেখেছি তার বহুস্বরিক পাণ্ডিত্য, বিষয়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, তথ্যের ভান্ডার, প্রসঙ্গকে  বহুরৈখিকভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীরতা। আমাদের অনেকে তাকে চলমান এনসাইক্লপিডিয়াও বলে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না হলেও আমি তাকে শিক্ষক হিসেবেই মানি। ফলে বন্ধুদের কাছে এই দাবি করতে আমার বাধে না যে আমি তাকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই চিনি।

বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে অন্য সবার মতো আমাদেরও পুরো সাহিত্য (বাংলা সাহিত্যের শুরু থেকে) সিলেবাসে বন্দি করেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু সেই বেড়ে ওঠাকে কজন ব্যক্তি, লেখক, আত্মস্থ করতে পেরেছেন? আমাদের মাস্টার্সে পড়ার সময় অনেক বন্ধুদের বলতে শুনেছি— কবিতা বুঝি না, আমি তাদের সোজা বলতাম তাহলে বাংলা পড়তে এসেছ কেন? প্রথম বর্ষে মনে আছে আমাদের বিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন আমিনুল ইসলাম (পরে যদিও উনাকে আর দেখিনি, কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন), তিনি প্রথম দিন ক্লাসে এসে বলেছিলেন কে কে এখন প্রেম করছ হাত তোল। স্বাভাবিক, প্রথম বর্ষ সবাই কাচুমাচু করছে, কে আর হাত তোলে। তখন তিনি বললেন, যারা প্রেম করছ আর যারা প্রেমে পড়ব পড়ব করছ তাদের সবার জন্যই বলছি- আগে একটু বিরতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়। তারপর সিদ্ধান্ত নাও কী করবে! আমি যদিও সেই কথার অর্থ এখনো বুঝি না। তবে হুমায়ুন আজাদ স্যার যখন দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম ক্লাসে এসে বলেছিলেন কাল সবাই সুধীন্দ্রনাথের ‘উটপাখি’ মুখস্থ করে আসবে। সেটা ছিল আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের, অনেক বেশি আত্মীকরণের। হয়তো বা যার সঙ্গে যেটা যায়। মানুষ তো সবকিছু তার অভিজ্ঞতা দিয়েই বোঝে। তাই যার অভিজ্ঞতা যেমন সে সেটাতে আকৃষ্ট হয়, সেটাতে তার ভালো লাগা প্রোথিত হয়। আমি কথাগুলো দিয়ে শুধু এটা বলতে চাইছি যে, কবি মজিদ মাহমুদকে দেখলে, জানলে বা কাছে গেলে আমার এমন উপলব্ধি হয়— তিনি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। সাহিত্যকে আত্মীকরণ করে, চুষে নির্যাস বের করে আনতে পেরেছেন তিনি। তাই ভাষার ওপর তার এত অবাধ শাসন, এত বহুবিধ জ্ঞান। আসলে মজিদ মাহমুদ শুধু সাহিত্য নয়, সব বিষয় সম্পর্কে এক আশ্চর্য জ্ঞানের আধার। সেটা তিনি যা-ই লিখুন, যে আঙ্গিকেই লিখুন না কেন।

এখন আমার হাতে রয়েছে তার একটি ব্যতিক্রম বই ‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’। এখানেও তিনি যে বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন সেগুলোকে নানাভাবে বলতে পারার দক্ষতা, তুলনামূলক আলোচনা করতে পারার ক্ষমতা যেমন অগাধ পাণ্ডিত্য ছাড়া সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সেই বিষয়টিকে নিজস্বতা দিয়ে আত্মস্থ করা ছাড়া। যারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন বা নিজেদের সেই কাতারে দাবি করেন, তাদের কম-বেশি সবাইকে একসময় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হয়। তিনি কার চিন্তা দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছেন বা কোনো কোনো কবির চিন্তা, আদর্শ, দর্শন তাকে আজকের ‘আমি’তে পরিণত করেছে।

কবি মজিদ মাহমুদের ব্যতিক্রমিতার জায়গা হলো তিনি কোনো একক বিষয়ের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করেননি। যখন তিনি রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন তখন তিনি সত্যিকারের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক; যখন ভাষা নিয়ে কথা বলছেন তখন তিনি সত্যিকারের একজন ভাষাবিদ; যখন তিনি সমাজ নিয়ে কথা বলছেন তখন তিনি সত্যিকারের সমাজতাত্ত্বিক; আবার যখন তিনি ধর্ম নিয়ে কিংবা দর্শন নিয়ে কথা বলছেন তখন তিনি একজন সত্যিকারের দার্শনিক। এত অবাধ, অগাধ বিষয়ে তার জানাশোন, বা বলা যেতে পারে চিন্তা ও বোধের সমন্বয় এবং ব্যুৎপত্তি।

এ প্রসঙ্গে তার দৈনিকে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর কথা বলাও আবশ্যিক। দৈনিকে সময়কে উপজীব্য করে লিখতে হয়, সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, ভীষণই মনে পড়ছে তার দামিনিকে নিয়ে লেখাটার কথা। ভারতে গণধর্ষণের স্বীকার হওয়া সেই ডাক্তার মেয়ে (সবার নিশ্চয়ই মনে আছে সেই সময়ের কথা)। মজিদ মাহমুদ কি অসাধারণ আলোচনাই না করেছিলেন— ভ্রূণ হত্যার মধ্য দিয়ে সারা ভারতে যে প্রতি সেকেন্ডে কতজনকে হত্যা করা হচ্ছে, সেই আলোচনা তুলে এনে। সে লেখার মধ্যে (হাতে নেই, স্মৃতি থেকে বলছি) পুরাণ, ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, লোকাচার কিছুই বাদ দেননি। এমনকি দামিনিকে নিয়ে অমিতাভ বচ্চনের ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাস পর্যন্ত তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। কে লিখেছে আর এমন? আমার জানা নেই। ভারত বা বাংলাদেশ— হালের রবাট ফিক্স, কিংবা অরুন্ধতি রায় যাদের এখনকার সময়ে আমরা সবচেয়ে বেশি তাত্ত্বিক বলে দাবি করি; কেউ কি লিখেছে এমন করে?

‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। যেমন— তিনি সেখানে যেসব বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন, বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে যে ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়েছেন— সেসব নিয়ে। আমি খুব ছোট করে বলতে চাই এই প্রবন্ধগুলো চিন্তার খোরাক জোগায়, ভাবনাকে পরিবর্তন করে। কবিরা কল্পনাকে উপজীব্য করেই শব্দের মালা গাঁথেন কিন্তু কবি মজিদ মাহমুদের গদ্য পড়লেও কল্পনার, ভাবনার উপসর্গ মেলে, যা আবার দাঁড়িয়ে থাকে তথ্যকে শিরদাঁড়া করে। ফলে যিনি পড়ছেন তিনিও অনায়াসে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন যতদূর তিনি যেতে চান। সবশেষে বলব, মজিদ মাহমুদই পারেন পাঠককে বাধাহীন দুরন্ত চলার সাহস জোগাতে, সীমাহীন যাত্রার কাছে নিয়ে যেতে। ৎ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads