• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদকসত্তা

ছবি : সংগৃহীত

সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদকসত্তা

  • বীরেন মুখার্জী
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৯

উনিশ শতকের সাহিত্যাদর্শ, ধর্মভাবনা, স্বদেশবোধ ও সমাজ সংস্কারের পীঠস্থল ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। জ্ঞানান্বেষণের এ কেন্দ্রভূমে দাঁড়িয়ে উনিশ শতক থেকেই বাঙালির মননশীলতা ও অভিজাত সংস্কৃতির আশ্রয়স্থল ও চর্চাস্থল হিসাবে পরিগণিত ঠাকুর পরিবারের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হতো বাংলার সামগ্রিক চিন্তাকে আলোড়ন করা বিখ্যাত চারটি পত্রিকা তত্ত্ববোধিনী, ভারতী, বালক ও সাধনা। উনিশ ও বিশ শতকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পেয়ে ধন্য হতো, অপরদিকে রবীন্দ্রনাথও পত্রিকাগুলোর মান নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট থাকতেন। একসময় রবীন্দ্রনাথকে সম্পাদক হিসেবে এ সব পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বভারও গ্রহণ করতে হয়। লেখক রবীন্দ্রনাথ কালপরিক্রমায় হয়ে ওঠেন সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ।

সাহিত্যসৃষ্টির ইতিহাসে তৎকালে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও রবীন্দ্রনাথ দায়িত্ব নেওয়ার পর তা হয়ে ওঠে আরো উন্নত। দীর্ঘদিনের সাহিত্য সাধনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ভান্ডার’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার দায়িত্ব নেন। এর কোনোটি মাঝপথে আবার কোনোটি শেষের দিকে। ‘সাধনা’ নামে মাসিক পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ও প্রতিভাধর সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল ভরসার জায়গাটিতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘সাধনা’র প্রথম সংখ্যাটি ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বৈজ্ঞানিক সংবাদ, সাময়িক সাহিত্য আলোচনা ইত্যাদি বিচিত্র সম্ভার নিয়ে ১২৯৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি অপশাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। পাঠকদের উপহার দেন বিচিত্র স্বাদের ছোটগল্প। সাহিত্য বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধসহ প্রথম বছরেই এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ প্রকাশিত হয়। ‘গোড়ায় গলদ’, ‘শিক্ষায় হেরফের’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘পঞ্চভূতের ডায়েরী’, ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’, ‘ইংরেজদের আতঙ্ক’ ইত্যাদি লেখাগুলো রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ ফসল হিসাবে সাধনার ক্ষেত্রভূমে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

রবীন্দ্রজীবনী পাঠে জানা যায়, ‘সাধনা’র জন্য কবি সবসময় উৎকণ্ঠিত থাকতেন। উড়িষ্যা, কলকাতা কিংবা রাজশাহীতে জমিদারী কাজের তত্ত্বাবধানে কিংবা পদ্মায় বোটে থাকাকালেও ‘সাধনা’র চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকতেন। সাধনার শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসাবে সাহিত্যালোচকরা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকেই চিহ্নিত করেছেন। সাধনায় প্রকাশিত দুটি গল্পমূলক কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। ‘ব্রাহ্মণ’ (ফাল্গুন-১৩০১) ও ‘পুরাতন ভৃত্য’ (চৈত্র-১৩০১) প্রকাশিত হলে তৎকালীন কুলশীল ব্রাহ্মণ সমাজ কবিতার মর্মবাণীকে মেনে নিতে পারেনি। ‘জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে/গোত্র তব নাহি জানি’ কবিতাটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ মাতৃত্বের যে অপরাজেয় অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে সামাজিক বিপ¬দকে সমর্থন করেছেন গোঁড়াদের এখানেই আপত্তি। এ কথা বলা অসংগত হয় না যে, ‘সাধনা’ দিয়েই পাঠকসমাজ রবীন্দ্রনাথকে যথাযথ চিনতে পারে। ‘সাধনা’ সম্পাদনার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের একটি অভিনব ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ভাষাগত ও অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে সরাসরি পাঠকদের কাছে তাদের মতামত জানতে চাইতেন। এতে করে পাঠকরা সম্পাদক ও পত্রিকার খুব কাছে চলে আসে এবং বলা যায়, সত্যিকার অর্থে সম্পাদক হিসাবে রবীন্দ্র ভাবনায় যে ‘কুঠার’ই ছিল ‘সাধনা’ পত্রিকাটি।

চিত্র, সাহিত্য, কাব্য, নাটক, সংগীত ইত্যাদি শিল্পের নানামুখী বিষয়ে ঠাকুর পরিবারের আরেক প্রতিভাধর ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ওপরেই তার যথার্থ প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জ্যোতিরিন্দ্র নাথ, অক্ষয়চন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ সকলে মিলে ঠাকুরবাড়ী থেকে একটি পত্রিকা বের করতে চাইলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল শুধু ধর্মীয় তত্ত্ব ও দর্শনের পথে না থেকে সাহিত্যধর্মী পত্রিকা বের হোক। তার মতামতের ওপর ভিত্তি করে সকলে সিদ্ধান্ত নিলেন পত্রিকা প্রকাশের। তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাম ঠিক করলেন ‘সুপ্রভাত’। পরবর্তীকালে নামটি পছন্দ না হওয়ায় সবাই মিলে নাম রাখলেন ‘ভারতী’। সম্পাদক নিযুক্ত হলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। পত্রিকাটি ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতী পত্রিকায় ভানুসিংহের কবিতা নামে ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নানা সম্পাদকের হাতে ঋদ্ধ হতে হতে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ এ পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার তখন একযুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময় জাতীয় ভাবনা, জাতীয় মত ও জাতীয় সমস্যা তুলে ধরার জন্য একটি বিশেষ পত্রিকার প্রয়োজন অনুভব করেন তৎকালীন বোদ্ধাসমাজ। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে ‘ভারতী’তে দুটি ধারার প্রবর্তন করেন। এর একটি, সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে প্রবন্ধ লিখে জাতীয় ভাবনা সুনির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত করা এবং অপরটি হলো পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য সাহিত্য প্রকাশ করা। সাহিত্যালোকগণ রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘ভারতী’ যুগকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য রচনার গদ্যযুগ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। সমাজ ও দেশের কাছে একজন সম্পাদকের যে দায়বদ্ধতা তা ‘ভারতী’ সম্পাদনা করে প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বঙ্গদর্শনে’র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। চার বছর সম্পাদনার পর বঙ্কিমচন্দ্র ১২০৯ বঙ্গাব্দে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে দায়িত্ব দিলেও শ্রীশচন্দ্র পত্রিকাটির প্রকাশনা ধরে রাখতে সমর্থ হননি। পরবর্তীকালে ১৩০৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পুনরায় প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের সম্পাদকীয় লিখতেন ‘পত্র সূচনা’ নামে। তিনি অকপট উচ্চারণ করেছেন- ‘এখনকার বঙ্গদর্শন কোনো উপায়েই তখনকার বঙ্গদর্শনের স্থান লইতে পারিবে না। এখনকার সম্পাদকের একমাত্র চেষ্টা হইবে বর্ত্তমান বঙ্গচিত্তের শ্রেষ্ঠ আদর্শকে উপযুক্ত ভাবে এই পত্রে প্রতিফলিত করা।’ রবীন্দ্রপাঠক জানেন, বঙ্গদর্শনের কাছ থেকে অবসার গ্রহণের পূর্বেই তিনি ‘ভান্ডার’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে মাসিক এ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় কেদার নাথ দাশগুপ্তের উদ্যোগে। এ পত্রিকায়ও তিনি ইংরেজদের বিপক্ষে শক্ত হাতে কলম ধরেছেন। ভান্ডারে প্রকাশিত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে তখন আপনি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, বাংলার মাটি বাংলার জল’ ইত্যাদি কালজয়ী গানগুলো প্রকাশিত হয় যা আমাদের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের চির সংগ্রাম-প্রেরণার উৎস। ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র হিসাবে অক্ষয় কুমারের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকাটিকে ধর্মমূলক পত্রিকা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ১৩১৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির সম্পাদনায় দায়িত্ব নিয়ে এটিকে বাংলা সাহিত্যের গুরু-গম্ভীর গদ্যের আদর্শ হিসাবে তৈরি করেন। প্রচলিত ধর্মের প্রতি নির্মোহ থেকে তিনি পত্রিকাটিকে গড়ে তুলেছেন আদর্শ পত্রিকা হিসাবে। রবীন্দ্রনাথ এ পত্রিকার আত্মপরিচয়ে বলেন- “আমি হিন্দু সমাজে জন্মিয়াছি এবং ‘ব্রাহ্ম সম্প্রদায়’ গ্রহণ করিয়াছি। ...আমরা যে ধর্মকে গ্রহণ করিয়াছি তাহা বিশ্বজনীন তথাপি তাহা হিন্দুরই ধর্ম। এই বিশ্বধর্মকে আমরা হিন্দু চিন্তা দিয়াই চিন্তা করিয়াছি, হিন্দু চিন্তা দিয়াই গ্রহণ করিয়াছি।”

রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ সম্পাদনাকালে ভারতীয় রাজনীতি অস্থির হয়ে ওঠে। এসময় তিলক গ্রেফতার, আয়ার্স্টের হত্যাকাণ্ড, শিবাজী উৎসবের ঢেউ, হিন্দুমেলার কার্যকলাপ বৃদ্ধি, প্লেগ মহামারীর আবির্ভাব, চরমপন্থী মতবাদের উত্থান, পুনাতে গোবধ নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠা, গণদেবতার পূজার ব্যাপক প্রচলনের সর্বজনীন রূপ, ইংরেজদের দিয়ে জনমত ও সংবাদপত্র প্রতিরোধ প্রচেষ্টাসহ নানাবিধ অমানবিক কার্যকলাপ রাজনীতিকে উত্তাল করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ এ পত্রিকায় লিখনীর মাধ্যমে এসবের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে লেখালেখি করেন। সুতরাং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সুসম্পাদক হিসাবে যোগ্য আসন করে দিয়েছে একথা জোর দিয়ে বলা যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads