• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

অনুবন্ধ

  • প্রকাশিত ২০ জুলাই ২০১৯

আজকের ঝড় যেন পদ্মা! এত হুট করে এলো! শুকনো ঝড় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। শুরু হলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, সাথে পাথুরে শীল। ঝড়ের একটু আগেই বারান্দায় বাবার থমথমে মুখ। হয়তো অভ্যাসে টেনে নেবেন চৌকা কাঠের টুল। অভ্যস্ত পায়ে শাল কাঠের খুঁটির গা ঘেঁষে দিনমান দাঁড়িয়ে থাকে চারপেয়ে টুল। আমি ঝড়ের চরিত্রে খুঁজে পাই মা, পদ্মা আর বাবার ছায়া।

কয়েক জোড়া কান যেন অপেক্ষায় ছিল। তবে ছুটে গিয়ে সদর খুলেছিলাম আমি। শৌখিন দাদাভাই! সাইকেলের সামনে প্লাস্টিক ফিতায় বোনা ঝুড়ি। ঝুড়ি ভরা শাদা জমিনে নীল ফুলেল পর্দা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পদ্মার ভ্রূর ভাঁজ বুঝতে বিছানায় বসে যখন জহুরির চোখ চালিয়েছিলাম, তখনই মনে বুনেছিলাম দাদাভাইয়ের সাথে কথার বুনন! বাস্তবে তাই সদর খুলেই দাদাভাইয়ের হাত ধরে এক টান!

‘আরে করো কী? সাইকেল ফেলবে? না আমাকে?’

আমি পাত্তা দিলাম না। তবে হাত ধরে আরেক টানে চৌচালার পেছনে যেতে পা বাড়ালাম। তার আগেই বাবার কলম পেষা হাত দাদাভাইয়ের গালে। প্রথম বার কি? কান্নার আড়ালে মায়ের মন কি সদর দরজাতেই নিবদ্ধ ছিল? নাকি বাবার ডান হাতের তালু মায়ের সজীবের গালে যে ক্ষণিক শব্দের জন্ম দিলো, তাতেই মা দৌড়ে এলো, সাথে কান্না নিয়ে। আমার হাত তখনো দাদাভাইয়ের হাতখানা ধরেই রেখেছে। মা যেন ভরসা হারালো। এক টানে তার সজীবকে কোলের কাছে টানলো। বাবার ক্রোধ ততক্ষণে মগডালে! ‘আমাদের ওপর তোমার কোন আস্থা নাই?’ মা কান্নার পালে রাশ টানলো। ‘আমাদের একমাত্র ছেলের বৌ এভাবে আসবে? কেন আমরা কি বেঁচে নাই?’

ঘটনাগুলো ঘটছিল যেন ফটাফট। এরপর দাদাভাইয়ের চোখ আমার চোখে। সেখানে জিজ্ঞাসা আর বিস্ময় মিলিয়ে একশ এক প্রশ্ন। আমার চোখের ভাষা অত প্রশ্নের উত্তর দিতে খেই হারালো। দাদাভাইয়ের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। খোঁয়াড় ছেড়ে ফুলদি আর পদ্মা যেন হাত ধরাধরি করে এলো! বাবার জন্য এক কাপ দুধ চা। আর অন্য সবার জন্য আদাকুচি দিয়ে রঙ চা। সাথে চাল ভাজা অথবা মুড়ি মাখা। আমরা বলতাম চা জল খাবার। এটা ছিল আমাদের বিকালের সম্পদ। আর বৃষ্টি বিকালের প্রাণ। আজো এ সবই হতে পারতো।

‘তোমরা সব জটলা বেঁধে কী করছো?’ অতর্কিতে আকাশীর গলার স্বরে দাদাভাই কেঁপে ওঠে কি? না বাবা? তার জ্বলন্ত চোখ দুটো যে নিভে গেল! উঠান পেরিয়ে বারান্দার সিঁড়ির এক ধাপ তারপর বারান্দা, তারপর ঘর। চলমান বাবার শরীর যেন ঝড়ের তাড়নায় নুইয়ে পড়া গাছ। মা হঠাৎই বাধ্য ছাত্রী! প্রশ্নের উত্তরে শতভাগ নম্বর আদায় করতে হরিণ পায়ে একচালার রান্নাঘরে একেবারে চুলার পাড়ে গিয়ে বসেন।

আমার মগজে জমা দৃশ্য চোখের পাতায় পর্দা ওঠায়। সেকেন্ডে দেখি চব্বিশটি ফ্রেম। রাঙা আপার জন্য বাবা কবর খোঁড়াচ্ছেন! রাঙা আপা নকশিপাড়ের শাড়ি ছেড়ে শাদা কাপড়ে সেজে উঠছে! কী ফটফটে শাদা! রাঙা আপা মাটির পেটের ভেতর ঢুকে গেল! মুঠ-মুঠ মাটি ওর চিহ্ন মুছে দিচ্ছে! আমি ঝাকরা লেবু গাছটার আড়ালে! রাঙা আপাকে চিরকালের মতো মগজের মধ্যে আটকে রাখছি! মা ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন— বুলি...বুলি! বুলি আমার রাঙা আপা। আমার রাঙা আপার মাটিতে মিশে যাওয়ার দিনেও বাবা ঠিক এমনিভাবে পা-মাথা এক করে বড় ঘরে এসে আড়াল খুঁজেছেন! আমার অন্তরাত্মা কাঁপে। দাদাভাইয়ের ভুল কি বিষ খাওয়ার মতো শুধরে না নিতে পারা কোনো ঘটনা?

‘আমাকে জল খাবার দিও না।’ শুধু এটুকুই বললেন বাবা। কেন বা কাকে বললেন সবকিছুই আমরা মনে মনে ধরে নিলাম। ফুলদির ধারণা দাদাভাই পর্দা বানানোয় যে টাকাটা জলে ফেলে দিয়েছে, সেটা ভাসাতেই বাবার জল খাবার বিসর্জন! তখনো দাদাভাইয়ের হাফ প্যান্ট। তখনো দাদাভাইয়ের নাম কৈশোরের খাতায় ওঠেনি। তখনো আমরা শিখিনি যুদ্ধ আসলে কি! মাটিতে কত কত লাল রং মিশে গেলে স্বাধীনতা পাওয়া হয়, তখনো আমাদের জানা হয়ে ওঠেনি!

সে সময়ের এক বিকালে দাদাভাই স্কুল ফেরত বাড়ি আসতে ভুলে গেল। আজ যে সাইকেলটা দাদাভাইয়ের হাতে ধরা; সেদিন এই সাইকেলটা বাবার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাহারবা চক্রদার তালে ঘুরতো। ভারসাম্য রাখতে যতটুকু ছন্দে যেতে হয় ঠিক ততখানি। এই টিনের সদর দরজা...হঠাৎ ক্রিং...ক্রিং। আমাদের গোপন আনন্দের ঘরে ভাদ্রের একপশলা বৃষ্টির মতো জল ঢেলে দেয় সাইকেল ঘণ্টি। মা মনে মনে ব্যাকুল হয় তার সজীবের নামে। আমি আর ফুলদি ছুটে গেলাম হাত ধরে। খালি পায়ে। বোসদের লিচু বাগান...বড় মসজিদের পাশে ফুটবল মাঠ। সেখানে হা-ডু-ডু খেলা শেষের পথে। না। দাদাভাই হা-ডু-ডু বা হৈ হৈ করে উৎসাহ দেয় যে দল, তার কোথাও নেই। আমাদের খেয়াঘাট পাড়া ছাড়িয়ে কালাচাঁদ পাড়া...যুগি পাড়া হয়ে যখন আমরা দু’বোন এসে সদর পেরিয়ে উঠানে পা রাখতে যাবো, দেখি দাদাভাই কান ধরে মাঝ উঠানে এক পায়ে খাড়া। মা বারান্দায় হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়েছেন। সেখানে পাটিতে বই-খাতা ছড়িয়ে রাঙা আপা আর নুয়া আপা পড়া মুখস্থের ভান করছে! দাদাভাই বাড়ি ফিরেছে...কোথাও হারিয়ে যায়নি! আমাদের বুকের মধ্যে রক্তের ঝলকানি। আনন্দের ধ্বনি। সব ছাপিয়ে গলা শুকালো মায়ের কথায়— ‘এতক্ষণে ফেরার সময় হলো?’ ওদিক থেকে রাঙা আপা ইশারায় বলছে, বাবা আমাদের জন্য বসে আছেন! ফুলদি আমার দিকে আর আমি ফুলদির পায়ে চোখ রাখি। নড়ি না এক পা-ও। মা বা কেউ বলে না হাত-পা ধুয়ে পড়তে বস। দাদাভাই তখনো তালগাছ! এবার আমি কান্না গিলে খাই। আমাদের যে কেন রাতের প্রথম প্রহর বুকে করে ফিরতে হলো, সে কথা কি কেউ জানবে কখনো? যুগি পাড়ার রাস্তার মাঝে যে বেলের ডালটা পরে ছিল; অন্ধকারে ঠাওরই করতে পারিনি। ফুলদি তখন ধপ করে মাটিতে বসে উঁ...আহ! ফুলদির ডান পায়ের গোড়ালিতে বেলের কাঁটা!

আবছা আলো অন্ধকারে আমি হাত দিয়ে ঠাওর করতে করতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম কাঁটাটা। সেই সাথে দেখলাম সে হাত, যে হাতে পেন্সিল টর্চ ধরা। আমাদের খালি পা। আমরা মাটি মাখা। ফুলদির পায়ে কাঁটা! আর তার পায়ে চপ্পল, পরনে ধুতি। ঝকঝকে পরিষ্কার। বললো— ‘শেষে কিনা ভর সন্ধ্যায় শিবঠাকুরের আঘাতে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছো! হা হা হা...। তারপর যখন আমার হাতে টর্চ ধরতে দিয়ে লাল পাথরের সোনার আংটি পড়া হাত ফুলদির মাটি মাখা পায়ে বিঁধা বেলের কাঁটা এক টানে বের করলো, তখন মনে হলো সব পুরুষ বাবার মতো রাগী না!

বাবা রাগী। তবে নিষ্ঠুর নয়। তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। তাই আজ দাদাভাইয়ের গায়ে আঁকা হলো প্রথম আঘাতের চিহ্ন।

শ্রাবণী প্রামাণিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads