• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদ

একজন গল্পের কবি

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৯

বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর হুমায়ূন আহমেদ দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি কথাসাহিত্যে মধ্যবিত্ত জীবনগাথা অঙ্কন করে বাঙালি পাঠক-হূদয় জয় করে জননন্দিত ও জনপ্রিয় কথাশিল্পী হতে পেরেছিলেন। জানি না, আর কত বছরে এ রকম আরেকজন জনপ্রিয় কথাকারের আবির্ভাব ঘটবে এই বাংলায়। প্রকৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিস্ময়াভিভূত দার্শনিকতা আমাদের মোহাচ্ছন্ন রাখে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের বৃষ্টি ও জোছনা বাঙালির জীবনাচরণে এক গভীর নান্দনিকতার জন্ম দেয়। রোমাঞ্চ, শোক, তাপ, আনন্দ— এসব কিছু বৃষ্টি ও জোছনার ভেতরে বাঙালি পাঠক খুঁজে পায় এক জীবনের একটি অংশ হিসেবে। নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগার— এ মধ্যবিত্ত আটপৌরে সংসারের আশা-আকাঙ্ক্ষা, টানাপড়েন, দুঃখ-ক্রোধ ইত্যাদির যে বাস্তবতা আমরা নিজেদের জীবনেই পরখ করে থাকি, তার বিস্তৃতি ঘটেছে হুমায়ূনের পরবর্তী রচনাগুলোতে মানুষের অবচেতন মনের কল্পবিন্যাসের ভেতরেই। সুতরাং একজন মিসির আলি, বয়সের ভারে নুব্জ, তথাপি মহাপুরুষের আকাঙ্ক্ষায় জীবনের পথে হেঁটে ফিরেছেন। আবার বেকারগ্রস্ত যুবক হিমু প্রবল জোছনার ভেতরে তার কল্পমনের বাসনাকে চরিতার্থ করতে নিরলসভাবে উদ্যত। এসবই মধ্যবিত্ত জীবনের না-পাওয়া প্রত্যাশাগুলোকে ছুঁয়ে দেখার এক আশাবাদী মানুষের প্রচেষ্টা। কিন্তু এ গল্পগুলোর ভেতরে মধ্যবিত্ত জীবনের আশা-নিরাশা, পাওয়া না-পাওয়ার সরলতা খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পের এই সরলতা পাঠকের মনে বিশ্বাস জন্মায়। অন্যভাবে বললে হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যের শিল্পরীতি বিষয়ভিত্তিক ও বক্তব্যনির্ভর। তাঁর গল্প-উপন্যাসে মধ্যবিত্ত সমাজের ছোট ছোট আবেগ, তুচ্ছ-ত্রুটি, লোভ, স্খলন ইত্যাদি অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। তিনি মধ্যবিত্তের জটিলতম সংকটের পরিবর্তে তার মনোবিকলনগুলোকে ধরার চেষ্টা করেন। উপরন্তু মধ্যবিত্ত জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতগুলোকে এত নিরাসক্ত চোখে দেখেন যে, তাঁর গল্প-উপন্যাসে সবই সহজভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। আর এ কারণেই সরলতা তাঁর কথাসাহিত্যের বিশেষ শিল্পরীতি। মিসির আলি কিংবা হিমু না হয়েও হুমায়ূনের ‘কবি’ উপন্যাসের কবি নাগরিক স্খলনের ভেতরে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, সেখানে মনোবিশ্লেষণ ও মনোবিকলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তা এ সমাজেরই আত্মপর চরিত। আর এই উপন্যাসে হুমায়ূনের কবিসত্তার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। এই কবিসত্তা বাঙালি মাত্রেই যে কবি, সেই সাক্ষ্য বহন করে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতেও হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের স্বপ্নকেই অন্বিষ্ট করে এগিয়ে গেছেন ভবিষ্যতের অনিশ্চিত ভাবনায়। সেই অনিশ্চয়তার পথ ধরেই মধ্যবিত্তের একটি শ্রেণি যেমন পালিয়ে বাঁচতে চায়, তেমনি আরেকটি অংশও ক্রোধে ফুঁসে ওঠে, রুখে দাঁড়ায়— এই দুই শ্রেণিকেই তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে তুলে আনেন সত্য ও প্রকৃত সত্যের ভেতরে। সুতরাং মধ্যবিত্তের চিরন্তন সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাধীনতা আসে বটে, কিন্তু এসব চরিত্র কখনো মহান হয়ে উঠতে পারে না, কেবল স্বাধীনতার সাক্ষী হওয়া ছাড়া। গল্প বুননে এই যে বিশ্বস্ততা, এটিই হুমায়ূনকে জনপ্রিয় করে তুলতে বাধ্য করেছে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কথাসাহিত্যে জীবনের চেতনা-প্রতীতির সঙ্গে বিশ্লেষণের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছেন। ফলে তিনি ঘটনা এবং প্রতিক্রিয়ার ঐক্য প্রতিষ্ঠাকল্পে জীবনের বাস্তব প্রচ্ছদকে স্বীকার করেছেন। তিনি বিমূর্ত চেতনাপুঞ্জকে বিমূর্ত নয়, বরং মূর্ত অবয়বে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। আর তাই ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল হয়ে ওঠে মধ্যবিত্তের জীবন-সংগ্রামের সহজ ও সরল পাঠের মধ্য দিয়ে। আবার ‘দেয়াল’-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম চরিত্র জাতীয় নায়ক বঙ্গবন্ধুকে আঁকতে গিয়ে বিশ্বস্ত থেকেছেন জাতির কাছে। যদিও সে বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে কোর্টেরও মুখোমুখি হতে হয়েছিল এক অজানা কারণে। তবু ‘দেয়াল’ পাঠকের কাছে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ— এই ত্রিবেণীর যুগপৎ আনন্দাশ্রু। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শহরকে কেন্দ্র করে যে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, তাদের জীবনযাপন প্রণালী, তাদের আশাভঙ্গের কাহিনি, আর্থিক টানাপড়েন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিত্বের সংকট, সুখ-দুঃখ, প্রেম-অভিমান ইত্যাদি বিষয়কে পুঁজি করে ‘নন্দিত নরক’ থেকে সবশেষ লেখা ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ পাঠককে নাড়া দিয়েছেন মধ্যবিত্তের জীবনদর্শনকে সহজ, সরল ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন বলেই। মধ্যবিত্তের এই জীবনদর্শন হুমায়ূনের চোখে এতটাই পরিষ্কার ছিল যে, তার বর্ণনা আমাদের নিজেদের জীবনাচরণে মিলে গেছে বহুবার। লেখনীর এ বিশ্বস্ততা তাঁকে পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে এবং সব থেকে জনপ্রিয় কথাশিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। মধ্যবিত্তের একজন হয়ে আমি নিজেও মধ্যবিত্তের জীবনকে হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাসে খুব নিবিড়ভাবে খুঁজে পেয়েছি বলেই হয়তো তাঁর ‘নন্দিত নরকে’র রাবেয়া আমার মর্মমূলে জায়গা করে নিয়েছিল। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এ বইটি পড়ে আমি ভেবেছি কয়েক মাস। লিখেছি রাবেয়াকে উপজীব্য করে কবিতা ‘সময়ের মৌলিক অন্ধকারে রাবেয়া’, যা আমার ‘শিখাসিমন্তিনী’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হুমায়ূনের মতো করে বৃষ্টি ও জোছনার গান আমি গেয়ে উঠতে পারিনি। যে কথা তিনি ‘কবি’ উপন্যাসের শুরুতে বলেছেন, “প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই/গৃহত্যাগী হবার মতো জোছনা কি উঠেছে?” না, সেই চাঁদনি রাত আসার আগেই তাঁকে চলে যেতে হলো। যে চাঁদনি রাতে তিনি মৃত্যু কামনা করেছিলেন। ‘পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে অন্য আকাশে।/চারদিক থেকে বিবিধ কণ্ঠে ডাকবে— আয় আয় আয়।’ হয়তো অন্য লোক থেকেই পূর্ণিমার চাঁদের আহ্বান তিনি শুনতে পেয়েছিলেন, হয়তো সেই আহ্বানেই সাড়া দিয়ে তিনি চলে গেছেন নিরুদ্দেশের পথে। তবু শতকোটি বাঙালি পাঠক-হূদয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের এই জননন্দিত জনপ্রিয় গল্পের কবি জ্বলজ্বল করবে মধ্যবিত্তের জীবনাখ্যানের ভেতরেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads