• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

রবিউল হুসাইন

জীবনচেতনায় পরিপুষ্ট কবি

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৯

স্নেহ করার মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন তারা। সময় তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে অতলের গহ্বরে। যাদের স্নেহে এগিয়ে যাবার প্রেরণা ছিল, তাদের একজন কবি রবিউল হুসাইন। দেখা হওয়ার আগে, কথা হয়েছে প্রথম। প্রযুক্তি সে সুবিধা দিয়েছে মানুষকে। তাই দেখা না হলেও, কণ্ঠ নিয়ে মুহূর্তেই পৌঁছে যাওয়া যায় যে কোনো প্রান্তের মানুষের কাছে। তখন একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করি। সেই সূত্রে প্রথম কথা হয় রবিউল ভাইয়ের সঙ্গে। মুঠোফোন নাম্বার জোগাড় করে কল দিই একদিন। নিজের পরিচয় দিয়ে বিনীতভাবে লেখার আমন্ত্রণ জানাই। উনি স্নেহ ভরে ভরসা দেন। সেই ভরসার হাত কখনোই সরিয়ে নেননি। যখনই প্রয়োজন হয়েছে, মুঠোফোনে অনুরোধ করলেই প্রথমে জানতে চাইতেন, কবে কখন লাগবে? সময় জানালে, নির্ধারিত সময়ের মাঝেই পাঠিয়ে দিতেন। এরপর দুবার কর্মস্থল বদল হয়েছে আমার। দায়িত্ব বদল হয়েছে। সাহিত্যপাতার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই নেই, তবুও যখনই যে কোনো সময়ে ডাক দিলেই একই আন্তরিকতায় সাড়া দিতেন। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিষয়ভিত্তিক একটি গদ্য আমাকে দিয়েছিলেন। যদিও সেটি এখনো অপ্রকাশিত। গদ্যটির মুদ্রিত রূপ তাকে দেখানোর সুযোগ  হলো না। কণ্ঠে পরিচয় প্রায় এক দশকের। কিন্তু দেখা হয়েছে মাত্র একবার। বন্ধু কবি মামুন মুস্তাফা তার সম্পাদিত ছোটকাগজ লেখমালা’র জন্য একটি স্মৃতিগদ্য চেয়েছিলেন রবিউল ভাইয়ের কাছে। গদ্যটি যেদিন দেওয়ার কথা, সেদিন লেখমালা’র আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রও ওনাকে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। মামুন মুস্তাফার অনুরোধে, তার সঙ্গী হই। সেই রবিউল হুসাইন ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখা। মাত্র একবারের দেখা, তবু এত আপন ছিলাম, এত স্নেহের ছিলাম, তার আয়ত্তে থাকা যে কোনো বিষয়ে, যার হয়েই অনুরোধ করেছি, কখনোই ফেলেননি। সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু কখনোই তিনি সামনে আসতে চাননি, প্রচারের আলোয় আলোকিত হতে চাননি। ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি হলেও, বহুলপঠিত তিনি ছিলেন না। দীর্ঘ সময়ে লেখার জগতে ছিলেন তিনি। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মাঝে রয়েছে স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট, আমগ্ন কাটাকুটি খেলা, কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে, আরও উনত্রিশটি চাঁদ, কর্পূরের ডানাঅলা পাখি, বিষুবরেখা, স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা, যে নদী রাত্রির, এইসব নীল অপমান, দুরন্ত কিশোর, বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি, অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ, ছড়িয়ে দিলাম ছড়াগুলি ইত্যাদি।

দুই.

রবিউল হুসাইন, কবি স্থপতি নগর পরিকল্পনাবিদ। তবে সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচিতি। পরিশুদ্ধ কবিতা রচনার মাধ্যমে তিনি নিজেকে স্পষ্ট করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের আবহে পরিপুষ্ট হয়েছে তার কবিতা। তিনি কবিতাকে কখনোই আত্মমুখী করে তোলার চেষ্টা করেননি। বরং অভিজ্ঞতা ও ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি শব্দের পরিচর্যা করেছেন। কবিতাকে তিনি শুধু আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই দেখেননি, বরং তার কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি জাতিসত্তার আত্মনুসন্ধানের পথও খুঁজেছেন, যা তার কবিতাকে করে তোলে সামষ্টিক চেতনার অংশ। রবিউল হুসাইনের জন্ম ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ সময়ে। সঙ্গত কারণেই দুবার মানচিত্র বদলের অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ। নিজের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ অঞ্চলের মানুষের আত্মবিকাশের ধারাটিও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। সেইসঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার কুশলী ছাত্র হিসেবেও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন নগরায়ণের অনুষঙ্গগুলো। যা একই সঙ্গে প্রকৃতি, মানুষ ও কৃত্রিমতা বিষয়ে নিবিড় পাঠের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে তার কবিতায় একই সঙ্গে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে জীবন ও তার বিস্তার। সমাজের বৃহত্তর অংশকে নাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। তার অভিজ্ঞার ভেতর দিয়ে, নিজের ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, যাতে করে ব্যক্তির উপলব্ধি স্বতন্ত্রতা লাভ করে। যাতে করে তার চেতনা সম্প্রসারিত হয় অন্যের ভেতরেও।

রবিউল হুসাইন শিল্পের জন্য শিল্পকে ধারণ করেননি। তিনি শিল্পের সঙ্গে জীবনকে, অভিজ্ঞতাকে, বাসনাকে মেলাতে চেয়েছেন। তাই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যেমন তেমনিভাবে ব্যক্তির আলোড়নকেও ধারণ করতে চেয়েছেন। আর এক্ষেত্রে শব্দের মালা দিয়েই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করেছেন। ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কখনো যুক্তির বাইরে যেতে দেননি, বরং যুক্তির নাগালের মধ্যে রেখেই ভাঙা-গড়া ও সৃষ্টির আনন্দে মেতেছিলেন।

‘মানুষেরা নাকি এক সেকেন্ডে চার ফুট হাঁটতে পারে সাধারণত/বারো কোটি মানুষ আমরা/আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটলে মোট আটচল্লিশ কোটি ফুট/অর্থাৎ ষোল কোটি গজ, তার মানে/এক সেকেন্ডে প্রায় নব্বই হাজার নয় শ দশ মাইল/এগিয়ে যেতে পারি/স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ বছর পার হয়ে গেছে/অথচ আমরা একই জায়গায় একই বিন্দুতে/দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়িয়ে মরছি সব সময়/এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারছি না/.../আসুন স্বাধীনতাযুদ্ধকে বুকের মাঝখানে রেখে তাই একসঙ্গে/আমরা সবাই এক সেকেন্ডে চার ফুট পথ এগিয়ে যাই/বন্ধুগণ এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট খুব বেশি কিছু নয়।’ (এক সেকেন্ডে মাত্র চার ফুট)

রবিউল হুসাইন তার কবিতার প্রতিটি মানুষের জন্য একটি গন্তব্য খুঁজেছেন। অবদমন করে রাখেননি যেমন তার অনুভূতিমালা, তেমনি অসহায়, দিগ্ভ্রান্ত পিক্তমালারও সমষ্টি নয় তার কবিতা। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি আলোড়িত হয়েছেন, সেই আলোড়নকে তিনি প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রবাহিত করে দিতেও শঙ্কা বোধ করেননি। যে ঘটনাস্রোতের ভেতর দিয়ে তার যাত্রা, সেখানে কেবল প্রতীক আর রূপকের বন্ধনে ভাবনার বিস্তারকে না বেঁধে তিনি যুক্তি ও বোধের জায়গাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। যাতে করে পাঠকের ভেতরেও সংক্রমিত হয় কবিচৈতন্য।

শুধু ব্যক্তিক অনুভূতিপুঞ্জকেই ভাষারূপ দেওয়ার চেষ্টা করেননি রবিউল হুসাইন। জনজীবনসংলগ্নতা এবং সমকালীন মানসিকতার বিরুদ্ধ সময়ে বন্দি থেকেও তিনি সমস্ত প্রচলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। সেখানে যুক্তি আছে মুক্তির সপক্ষে। হূদয়াবেগকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু নির্লিপ্ত হয়ে নয়। ভেতরের অস্থিরতা এবং সংঘাতকেও তুলে ধরতে চেয়েছেন প্রতীকী ব্যঞ্জনার ভেতর দিয়ে, যা কবির কবিতাকে করে তুলেছে তাৎপর্যময়। তার অনুভূতিপুঞ্জকে করে তুলেছে চিত্রময়। শিল্পের জন্য শিল্পের প্রচল প্রথায় আবদ্ধ না থাকার কারণেই ভিন্নতর পাঠ হয়ে উঠেছে তার কবিতা, যেখানে তিনি শুধু নির্লিপ্ত দ্রষ্টা নন, বরং এমন এক শিল্পী যিনি একই সঙ্গে সৃষ্টি করেন ও তার সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সঞ্চার করেন তীক্ষ অনুভব। অন্তর্গত টানাপোড়েনের চেয়ে সামষ্টিক চেতনার চর্চাকে তিনি ব্যাপকতা দিয়েছেন কবিতায়। মানবিক বোধকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াসের ভেতর থেকে রবিউল হুসাইন কবিতাকে শব্দময় করে তুলেছেন, যেখানে তার কবিতা একটি সুস্পষ্ট মীমাংসায় উপনীত হয়। তিনি যখন বলেন, ‘দেশ ও দশের এখন দেশজ চিকিৎসা প্রয়োজন।/শুকনো মাটির সঙ্গে মানুষের হলুদ পেশাব মিশিয়ে/কাদা কাদা যে মাটির মণ্ড হবে/আদিগন্ত সেই প্রলেপ লাগাতে হবে/তাদের বিস্তীর্ণ কপালে,/দেশ ও দশের যন্ত্রণাকাতর শিরঃপীড়ায়/হবে নিশ্চিত নিরাময়।/.../দুস্থ দেশ আর দুর্বল দশের জন্যে, যতই দিন যায় মনে হয় এখন/বেদে আর বাউলদের সহজিয়া বিন্দু-সাধনা/যৌন যোগ-ব্যায়াম/আর এইসব দেশজ আর ভেষজ ওষুধের/আজ বড্ড প্রয়োজন।’ (দেশ ও দশের দেশজ ওষুধ)

সুস্পষ্ট মীমাংসার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় রবিউল হুসাইনের স্বাদেশিকভাবনা। সময়স্রোতকে তিনি ধারণ করেছেন। সম্ভাবনার পথ দেখিয়েছেন। তার প্রকাশক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তার অভিরুচি পাঠককে ছুঁয়েছে। বহুপ্রজ ও বহুলপঠিত কবি তকমা না এঁটেও রবিউল হুসাইন ষাটের দশকের কবিতার প্রচল ধারার বিপরীতে স্বাবলম্বী হওয়ার যে পথ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং অফুরন্ত সম্ভাবনার যে পথের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তার ভেতরে খুঁজে পাওয়া যায় ভিন্নতর উপলব্ধি। ব্যক্তি মনের সঙ্গে শিল্পের যে যন্ত্রণাকতার সহাবস্থান প্রতিনিয়ত তার অদম্য স্ফুরণ ঘটানোর অঙ্গীকারের ভেতরেই জাগরূক থাকবেন রবিউল হুসাইন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads