• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের পৃথক একটি শাখা মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য

  • রবিউল হুসাইন
  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৯

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। তার স্থাপত্যশৈলীর মতো পরিশুদ্ধ কবিতা রচনার মাধ্যমে তিনি নিজেকে স্পষ্ট করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের আবহে পরিপুষ্ট হয়েছে তার কবিতা। তিনি কবিতাকে কখনোই ‘আমিত্ব’-এর ভেতরে সীমাবদ্ধ করেননি। বরং অভিজ্ঞতা ও ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা জনমানুষের গ্রহণীয় করে তুলেছেন। ফলে তার কবিতা জাতিসত্তার আত্মানুসন্ধানের পথের খোঁজ দিয়েছে বাঙালিকে। আর এ কারণেই তার নকশায় স্থাপত্য নিদর্শন হতে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট, ভাসানী হল ইত্যাদির মাধ্যমে। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার। ২০১৮ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের খবর-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন রবিউল হুসাইন। কবির প্রয়াণে সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।

 

বাংলাদেশের খবর : আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতে আমাদের সে সময়ের সাহিত্য কতখানি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল বলে আপনি মনে করেন?

রবিউল হুসাইন : স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতে তখনকার রাজনীতি— পাকিস্তানিদের বৈরিতা, ক্রমাগত শোষণ, নির্লজ্জ পক্ষপাত, সেনাশাসনকৃত তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচন, বাঙালিদের হেয় প্রতিপন্ন করে সর্বক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন একটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের দিকনির্দেশনামূলক কৌশলী বিচ্ছিন্নতা এড়িয়ে যুক্তিপূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা, ’৫২ থেকে ধারাবাহিকভাবে ৫৪-৫৯-৬৪-৬৬-৬৯-৭০-৭১ পর্যন্ত বাঙালি ও বাঙালিত্ব নিয়ে সর্বজনের সমর্থনের মাধ্যমে তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলন এ ক্ষেত্রে উল্লেখের দাবিদার। ফলে বহমান শিল্প, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নির্মাণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহিত্যিকরা তাদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, শিল্পকর্ম, সংগীত ও চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল ভূমিকা রেখেছেন যার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গতিশীল হয়ে সার্থকতা লাভ করেছে। 

বাংলাদেশের খবর : একজন কবি বা লেখক যখন মুক্তিযোদ্ধা হন, তখন লেখকের অজান্তেই মুক্তিযুদ্ধ কি তার সাহিত্যকে প্রভাবিত করে না?

রবিউল হুসাইন : কবি বা লেখক মুক্তিযোদ্ধা হলে অবশ্যই তার কাব্য বা লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ প্রভাব পড়বে। এটা খুব স্বাভাবিক। কেননা জীবন অভিজ্ঞতার নানান স্তর পেরিয়ে বাস্তবতায় সমৃদ্ধ হয়। এজন্য বাংলা সাহিত্যে পৃথক একটি সাহিত্য শাখা তৈরি হয়েছে, যাকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করা যায়।

বাংলাদেশের খবর : আপনি নিজেও একজন কবি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রাহক, আপনার রচনায় মুক্তিযুদ্ধকে আপনি কীভাবে দেখেন?

রবিউল হুসাইন : মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয় না। এটা সব সময় চলতে থাকবে। এই স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষুধা, দারিদ্র্য, কূপমণ্ডূকতা, অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, অপসংস্কৃতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সদা সর্বত্র চলবে। এটি এক অনিঃশেষ ধারাবাহিক পরিক্রমা। মুক্তিযুদ্ধের সারাৎসার অর্থাৎ মা-মাটি ও মাতৃভাষার প্রতি অবিচল বিশ্বাস, সম্মান ও শ্রদ্ধার মূল বীজকে ধারণ করেই সবাইকে সামনের দিকে এগুতে হবে। এ জন্য আমরা কয়েকজন মিলে সবার সহযোগিতা ও সাহায্য এবং অনুকূল সমর্থনে আগারগাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ে তুললেও তা এখন জনগণের জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার জন্য আমরা সবাই গর্ববোধ করি। 

বাংলাদেশের খবর : মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়কালকে ধারণ করে রচিত কাব্য শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’। এ ছাড়া হাসান হাফিজুর রহমানের ‘যখন উদ্যত সঙ্গীন’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কিছুটা হলেও প্রতিফলিত করেছে। পরবর্তীতে আর কোনো কবির মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একক কাব্য আমরা পাই না, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওই সময়টিকে পাঠক আবিষ্কার করতে পারে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

রবিউল হুসাইন : মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধ কালে কালে কালজয়ী প্রাসঙ্গিক সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক— সব সৃষ্টির মধ্যেই আছে। এটা মাত্র শুরু, আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে আরো সৃষ্টি হবে। প্রেমের কবিতা-গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের ফল্গুধারা অবিরত, অবিরাম ও অনিঃশেষ। এই প্রবহমানতা কখনো থেমে থাকবে না— এটি চলমান, চিরকাল অগ্রসরমাণ হয়ে রইবে।

বাংলাদেশের খবর : আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে কখনো খণ্ডিত আকারে, কখনো কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিকতাকে ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয়নি— না শিল্প-সাহিত্যে, না চলচ্চিত্র বা নাটকে। এই সীমাবদ্ধতার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

রবিউল হুসাইন : এটা সীমাবদ্ধতা নয়, এটা অসীম পথের পথিক। সময়মতো ঠিকই এটি সম্পূর্ণ রূপ নেবে। এত ত্বরিত বা চটজলদি শিল্প রচনা করা যায় না। ঠিক সময়ে অবশ্যই তা কোনো সৃষ্টিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক-কবির হাতে নিশ্চয়ই পরিপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হবে।

বাংলাদেশের খবর : আপনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রাহক এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

রবিউল হুসাইন : মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য-শিল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নানান প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনা মৌখিক-লিখিত বিবরণপঞ্জি যা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এগুলো সঠিক সম্পাদনায় বইয়ে বিবরণ লিপিবদ্ধ করা এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে পাঠাগারে রাখার ব্যবস্থা করা; মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্প বা দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা তৈরি করা। তাছাড়া জাদুঘরে আলাদা একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, শিল্পকর্ম, পোস্টার— সবকিছু নিয়ে একটি পাঠাগার ও বিক্রয়কেন্দ্র এর মধ্যেই চলমান আছে। এখানে পাঠকরা বই কিনতে বা পড়তে পারবেন। ইতোমধ্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম যা দেশের প্রথিতযশা শিল্পীগণ সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো নিয়ে একটি শিল্প-গ্যালারি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি।

বাংলাদেশের খবর : আপনার স্থাপত্য শিল্পে মুক্তিযুদ্ধ এবং আপনার রচিত সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ— এ দুটোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

রবিউল হুসাইন : স্থাপত্য শিল্প ও সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে আমি গল্প-কবিতা-ছড়া, প্রবন্ধ-নাটক ও কিশোর উপন্যাস যেমন রচনা করেছি, তেমনি বেশ কয়েকটি স্বাধীনতা স্তম্ভ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় আমার নকশায় তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের খবর : বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা— স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠায় একজন লেখকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

রবিউল হুসাইন : এই চার নীতিই আমাদের রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যদিও বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বারবার বিভিন্ন সময়ে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে, তবে সেসব বাধা কাটিয়ে আমাদের সবাইকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে।

বাংলাদেশের খবর : বাঙালি বর্তমান সময়ের লেখকদের চিন্তা-চেতনায়, লেখায় মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে বলে আপনি মনে করেন? 

রবিউল হুসাইন : এ সময়ের লেখক-কবিদের বাঙালি ও বাঙালিত্বের প্রজ্ঞা ও সারবস্তু সব সময় তাদের চিন্তা, চেতনা ও দর্শনে প্রভাব বিস্তার করবে। এটাই তাদের অসীম সাহস ও অনির্বাণ উদ্দীপনা-অনুপ্রেরণা অনিঃশেষিতভাবে জুগিয়ে চলবে।

বাংলাদেশের খবর : মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোন বইটি আপনাকে আকর্ষণ করেছে এবং কেন?

রবিউল হুসাইন : শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এর মধ্যে এ অঞ্চলের সংগ্রাম, মা-মাটি-ভাষা, যুদ্ধ, স্বাধীনতা ও এদেশের অকুতোভয় মানুষদের পরিষ্কার ও পরিপূর্ণভাবে খুঁজে পাই।

বাংলাদেশের খবর : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

রবিউল হুসাইন : নতুন দৈনিক হিসেবে বাংলাদেশের খবরের প্রতি রইল নিরন্তর শুভেচ্ছা। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads