• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

অনুবন্ধ

  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৯

শ্রাবণী প্রামানিক

 

 

দুধকুমুড় নদীর পাশে ছোট গ্রাম পাঙাসী। দাদিমায়ের মুখে এই গ্রামের নাম যতবার শুনতাম, আমার চোখের সামনে পলাশ আর শিমুল ফুলের রং ছড়িয়ে পড়ত। কখনো কাউকে জানানো হয়নি একথাটা। শুধু মনে হতো এক দিন আমি দুধকুমুড়ের পাড়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা দেখব। দাদিমাকে এক দিন সেই কথাটা বললাম—তোমার বোনের বাড়ি বেড়াতে যাবে দাদিমা?

—আমার বোনের বাড়ি? পাঙাসী?

—হ্যাঁ, দাদিমা। নিয়ে যাবে আমাকে ওই গ্রামে?

—কেন রে বুনি? সে গ্রামে কেন? আমিই তো কোনোদিন যাইনি সেখানে। আমার বুজির শ্বশুরবাড়ির গ্রাম পাঙাসী। শুনেছি, বুজি ভরা মাসে কলসি কাঁখে নিয়ে পুকুরের ঢাল বেয়ে ওঠার সময় পিছলে পড়ে যায়। আর কোনোদিন চোখ মেলে তাকাতে পারেনি।

আমি চমকে উঠি! তবে স্তব্ধ হওয়ার বদলে রাগে, দুঃখে কেঁদে উঠি। আমার আচরণে দাদিমা ঘাবড়ে যায়, কী হলো...কী হলো বুনি? ওমন করে কাঁদছো কেন?

আমি কান্নার ফুলে ফুলে ওঠা পালে রাশ টেনে ধরি, তুমি কোনোদিন যাওনি পাঙাসী? তহলে ওখানকার দুধকুমুড়, সবুজ মাঠ, সারা গ্রামময় ফুল আর ফলের গাছের গল্প বলতে কেন? তোমার বুজি যে ঘুমিয়ে পড়েছে পুকুড় পাড়ে; সে কথাও তো এত দিন বলোনি?

—এজন্য তুই কাঁদছিস বুনি? হুম সে তুই কাঁদতেই পারিস; যদি তোর দেখার চোখ না থাকে?

—কী বললে তুমি? আমার চোখ নাই? আমি খুব রেগে কান্নার তোড়ে দুই হাতে মুখ ঢাকি।

—চোখ কেন থাকবে না বুনি? তবে দেখার চোখটা তো কপালের ঠিক মাঝখানে থাকে। দুই চোখ বন্ধ করে যদি তুমি চাও, তৃতীয় চোখে দুধকুমুড় নদী দেখে আসবে, তবে তুমি নিশ্চিত তা পারবে বুনি। বুজির বিয়ের পরে প্রথম প্রথম যখন নাইওর আসত, আমি বুজির মুখে পাঙাসী গাঁয়ের গল্প শুনতে শুনতে মায়ায় পড়ে যাই। তারপর যখন বুজির কথা মনে পড়ত, চোখ বন্ধ করলে; খুলে যেত আমার কপালের চোখ! আমি চলে যেতাম পাঙাসী। বুজির কাছে। দুধকুমুড়ের পাড়ে।

দাদিমা হঠাৎই আমার কপাল ও থুতনিতে দুই হাত দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে দিলেন পুঁইশাকের মাচাং বরাবর। আমি তাকাতেই দেখি; একটা দোয়েল পুঁইয়ের নরম সবুজ ডগা দুলিয়ে দিয়েই উড়ে গেল। আমার মুখটা চেপে ধরায় আমি দাদিমায়ের ওপর আরো বিরক্ত হলাম—একটা পাখি উড়ে যাওয়া আবার এভাবে দেখাতে হয়?

—হয় রে বুনি হয়। পাখিটা কোথায় গেল বলত?

—কোথায় আবার? আকাশে।

—হ্যাঁ, আকাশে। এই দোয়েল হয়তো উড়ে পাঙাসীই গেল!

আমার মুখ এতক্ষণে বিস্ময়ে গোল হয়ে গেল! হবে নাই বা কেন? তখন আমি শুধু বছর পাঁচেকের; আর দাদাভাই মায়ের পেটে!

—তুমি কীভাবে জানলে, দোয়েলটা পাঙাসীই গেল।

—যদি আজ না যায়, অন্য এক দিন যাবে। ওই দোয়েলটা না গেলে ওর যে একটা বোন দোয়েল আছে, সে যাবে। তবে যাবেই।

আমি দাদিমায়ের কথা শুনে অবাক তো হচ্ছিই, সেই সঙ্গে কথাটা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছা করছে। আবার অবিশ্বাসে মনটা তির তির কাঁপছে! আমার চিন্তার দুনিয়ায় হানা দিয়ে দাদিমা আবার শুরু করলেন আকাশটা দেখেছ তো বুনি? তোমার মাথার ওপরে যে আকাশ তুমি দেখ, সেই একই আকাশ কিন্তু দুনিয়ার সব মানুষের মাথার ওপরে।

—একই আকাশ? তাহলে আমি যে চাঁদ দেখি; মামাবাড়ির সবাই সেই চাঁদই দেখে?

—ঠিক বলেছে বুজি। শুধু চাঁদ কেন? সূর্য বা তারাও একই।

আমি হয়তো তখনই কোনো একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম; দাদিমা থামিয়ে দিয়ে বললেন—বুজি, যে দোয়েলটা উঠে গেল পাঙাসীর দিকে, ওর ঠোঁটে একটা পুঁইয়ের বিচি ছিল। যদি উড়তে উড়তে মুখ থেকে পড়ে যায় বিচিটা তখন কি হবে বলত?

—কি হবে! বিচিটা যেখানে পড়বে সেখানেই একটা এরকম পুঁইগাছ হবে।

—এই তো, আমার বুজি সব বোঝে।

দাদিমা আমার গালটিপে আহলাদ করলেন, জান তো বুজি, এভাবে আমাদের মাচাঙের পুঁইও কিন্তু অন্য কোথাও চলে গেল। অন্য কোন দেশে।

ঠিক তখনই বড় ঘর থেকে বাবা এলেন হাসতে হাসতে ছোট আম্মা, তুমি কিন্তু পুঁইয়ের বিচি নও। তুমি মানুষ। মানুষকে এক জাগয়া থেকে অন্য জায়গায় নিতে পারে শুধু, বই! তুমি যত পড়বে, তত ছড়িয়ে পড়বে।

আমার কানে যখন-তখন ভেসে আসে বাবার একথাটা—‘তুমি যত পড়বে, তত ছড়িয়ে পড়বে’। সেই সময় কথাটার অর্থ বুঝিনি, বাবাও বুঝিয়ে দেননি। বলেই হন হন করে গেটের দিকে হেঁটে গিয়েছেন। তবে যখন প্রথম বুঝেছি, ইচ্ছা হয়েছিল, বাবার পা ছুঁয়ে বসে থাকি জনম জনম।

আর দাদিমা! তোমাকে খুব করে আর একবার ছুঁয়ে দেখতে চাই। তুমি না থাকলে কে আমাকে তৃতীয় নয়ন দিত! আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দাদিমার তৃতীয় চোখওয়ালা ভাঁজ পড়া কপালের নিচে ছলছল দুই চোখ দেখতে পাই!

কত...কত দিন আগের জমানো গল্প আজ ছবির মতো চোখের সামনে দেখতে পেলাম, বাবার একটি কথায়! বাবার ওপর হঠাৎ তৈরি রাগ-অভিমান নিয়ে তারই ডাকে আজ যখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, তিনি বললেন পদ্মার কথা! বললেন—তোমাদের দাদাভাই আর একা একা বড় হয়ে উঠতে পারবে না। পদ্মাকেও ওর সঙ্গে সমানতাল রেখে বড় হতে হবে। তবেই ওদের জীবনের ভারসাম্য বজায় থাকবে।

আমার মুখের কথাটা যেন হারিয়ে গেল। আমি বাবার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বাবা হয়তো কিছু আঁচ করতে পারলেন, তোমাদের আমার সাধ্যমতো আমি লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা দিতে চেষ্টা করেছি...এখন পদ্মা এই বাড়ির সদস্য হিসেবে তারও সেসব সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য। এবার আমি কিছুটা বুঝলাম এবং অবাক হলাম! বাবা এত চিন্তা করেন!

—ছোট আম্মা...

আমি আত্মহারা হয়ে পড়লাম। বাবা আমাকে ছোট আম্মা বলে ডাকছেন! তার মানে আমার ওপর তিনি আর রাগ করে নেই! কিন্তু আমি? বাবা এত বোঝেন? তবে বড় দুলাভাইকে ভুল বুঝলেন কীভাবে? আবার আমার অভিমান ফুঁসে উঠতে শুরু করল।

—ছোট আম্মা কী ভাবছো? এদিকে তাকাও। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি...

আমি মুহূর্তকাল এই ঘর থেকে যেন অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলাম...

—জি বাবা, আমি শুনছি...

— আজ তোমার সঙ্গে পদ্মাকে নিয়ে চলো কলেজে।

আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হলো দুই অক্ষর—মানে? আমার বিস্ময় চোখের চাহনি দেখেই কী বাবা অমন এক ফালি হেসে উঠলেন? আমার নিজেকে বোকা বোকা মনে হতে লাগল।

—না না...পদ্মা কলেজে ভর্তি হবে না। তোমার সঙ্গে বসে থাকবে তোমার ক্লাস যতক্ষণ হবে। তারপর তুমি ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তোমাদের সরকারি স্কুলে। হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে পদ্মাকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করে আসবে। আমি জানি এটুকু দায়িত্ব তুমি পালন করতে পারবে। এ আমার বিশ্বাস ছোট আম্মা।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম ফ্যাল ফ্যাল... 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads