• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

শেকড়ের সন্ধানে কলের গান

  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯

জোবায়ের আলী জুয়েল

 

 

১৮৭৭ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন শব্দযন্ত্র আবিষ্কার করে নামদেন ফোনোগ্রাফ। পরবর্তীকালে বার্লিনার রেকর্ড সিলিন্ডারের আকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে প্লেটের মতো সমতল রেকর্ডের প্রবর্তন করেন। ফোনোগ্রাফের ডায়াফ্রামের সঙ্গে চোঙা লাগিয়ে স্বর বিস্তারের ব্যবস্থা ছিল বার্লিনারেরই আবিষ্কার, যা টমাস এডিসনের ফোনোগ্রাফেরই উন্নত সংস্করণ, যাকে পরবর্তী সময়ে কলের গান নামে অভিহিত করা হয়। সে সময় থেকে ফোনোগ্রাফকে আদর করে গ্রামোফোন বা কলের গান নামে ডাকা হতে থাকে।

আর ১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর গোটা ভারত ভূমিতেই গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। এই দিনটিতেই গেইস বার্গ প্রথম বাঙালি শিল্পীর কণ্ঠে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেন। সেই প্রথম গানটি ছিল কীর্তনের ‘কাঁহা জীবন ধন’, কণ্ঠ দিয়েছিলেন ক্ল্যাসিক থিয়েটারের চতুর্দশী নর্তকী মিস শশীমুখী। ওই একই তারিখে দ্বিতীয় গানের রেকর্ডিং হয় ক্ল্যাসিক থিয়েটারের আরেক নর্তকী মিস ফণীবালার কণ্ঠে। পরবর্তীকালে ১০ নভেম্বরে আরো কিছু শিল্পীর গানের রেকর্ড করার সুযোগ মেলে কিন্তু এরা কেউই তখন গানের জগতের বড় শিল্পী ছিলেন না। সে সুযোগ এলো কলকাতার বাঙালি রমণী গওহর জানের কল্যাণে। রূপের ছটা আর রেওয়াজি কণ্ঠের দৌলতে গওহর জান সেকালের সৌন্দর্য পিপাসু ও সংগীত রসিক মানুষের মন কেড়েছিলেন। গোটা ভারতবর্ষে তখন তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। এই গওহর জানই ছিল গেইস বার্গের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার নিঃসন্দেহে। ১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর গেইস বার্গ গওহর জানের কণ্ঠে গান রেকর্ড করেন। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ডে তার গানগুলো ধারণ করা হয়। গওহর জান হিন্দুস্থানি ভাষায় দাদরা তালে প্রথম গানটি রেকর্ড করেছিলেন। গওহর জানের ধারণকৃত প্রথম বাংলা গানটি ছিল ‘ভালো বাসিবে বলে ভালো বাসিনে’। কলকাতার সকল সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় তার ছবি ছাপা হয়। এভাবেই গোটা ভারতবর্ষে অতি শীঘ্র গ্রামোফোন রেকর্ডের এক বিশাল বাজার পরিণত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে সে আমলে গওহর জান চলচ্চিত্রের একজন সফল নায়িকাও ছিলেন। ১৯০২ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলা রঙ্গমঞ্চের দুই নামকরা শিল্পী হরিমতী ও সুশীলাও গেইস বার্গের নজরে পড়েন। তাদের দিয়েও গেইস বার্গ একের পর এক থিয়েটারের বাদক দলের সমন্বয়ে গানের রেকর্ড করিয়ে নেন। রেকর্ডিংয়ের প্রথম পর্যায়ে গানের পুরুষ শিল্পী তেমন পাওয়া যায়নি। একমাত্র অভিজাত পরিবারের সন্তান গায়ক লালচাঁদ বড়াল ছাড়া। লালচাঁদ গ্রামোফোনের শিল্পী হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তার রেকর্ডের চাহিদা ছিল আকাশচুম্বী। প্রায় শিল্পী গওহর জানের কাছাকাছি। ১৯০৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এই গুণী শিল্পীর অকাল মৃত্যু হয়।

গেইস বার্গের শুভ সূচনায় এক দশকের মধ্যে গ্রামোফোন হয়ে উঠলো সমগ্র ভারতবর্ষের আমজনতার জনপ্রিয় বিনোদনের সামগ্রী। ১৯০০ সালের মধ্যে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ফোনোগ্রাফ যন্ত্র পৌঁছে যায়। ১৯০৩ সাল নাগাদ সাহিত্যসেবী ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচয়িতা কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামে মীর মশাররফ হোসেনের বাড়িতেও কলের গান পৌঁছে যায়। সম্ভবত এর আগে কোনো মুসলমান ঘরে কলের গান পৌঁছানোর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য অদ্যাবধি পাওয়া যায় না। বিংশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জনপ্রিয় বিদেশি গ্রামোফোন কোম্পানি হচ্ছে হিজ মাস্টারস ভয়েজ (ব্রিটিশ), কলম্বিয়া (আমেরিকা) এবং পঠে (ফ্রান্স)।

গ্রামোফোনের রেকর্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথম ভারতীয় উদ্যোক্তা হলেন হেমেন্দ্র মোহন বসু (১৮৬৪-১৯১৬)। ময়মনসিংহের  জয়সিদ্ধ গ্রামে তার জন্ম। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করেন। ১৯০০ সালে তিন পাশ্চাত্য থেকে গ্রামোফোন বা কলের গান তৈরির প্রযুক্তি আমদানি করে কলকাতায় একটি গ্রামোফোন বা কলের গান রেকর্ডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রস্তুত ও বিতরণ শুরু করেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম এবং এ ব্যবসায় তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। বাজারে তার রেকর্ড “এইচ বোস’স রেকর্ড” নামে পরিচিতি লাভ করে। তার তৈরি রেকর্ডের মাধ্যমেই জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবৃত্তি, বাণী ও সাক্ষাৎকার ধারণ করা সম্ভব হয়। বোস’স রেকর্ড বাংলা, হিন্দি ও উর্দুতে অনেক অনুষ্ঠান ধারণ করে। ১৯০৭ সাল থেকে এইচ বোস’স রেকর্ডের অসংখ্য ডিস্ক বাজারে মুক্তিপায় এবং এর চাহিদা ক্রমশ এতই বৃদ্ধি পায় যে, হেমেন্দ্র  মোহন বসু অবিভক্ত ভারতের একজন খ্যাতিমান ও সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। কারণ তিনি ছিলেন একজন বাঙালি উদ্যোক্তা এবং স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের ওপর অনেক রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি মারা যান।

গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতার মানিকলাল শাহা (এম. এল. এস.)। এর আগে তিনি ছিলেন একজন সফল হারমোনিয়াম নির্মাতা। মানিকলাল শাহা লন্ডনের নিকল ফেরেস লিমিটেডের নিকল রেকর্ডস ও নিকল ফোনের প্রথম ও প্রধান এজেন্ট ছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেকর্ডস ম্যানিউফ্যাকচারিং কোম্পানি লি. প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতকের বিশের দশক থেকে গ্রামোফোন ও গ্রামোফোন রেকর্ডস বাঙালি পরিবারে একটি মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। যখন স্টেরিও গ্রামোফোন স্থান দখল করেছিল তখন পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল।

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের জমিদার পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ স্যার আবদুল হালিম গজনবী হলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান, যিনি গ্রামোফোন সামগ্রীর ব্যবসায় নেমে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। এছাড়াও মীনা পেশোয়ারি নামক এক অবাঙালি ধনী মুসলমান ১৯২৬ সালে ‘শাহন শাহ’ রেকর্ড কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। চণ্ডীচরণ সাহা, বিভূতিভূষণ ও জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ তিরিশের দশকের গোড়ার দিকে গড়ে তোলেন স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানি ‘মেগাফোন’, ‘হিন্দুস্তান’ ও ‘সেনোলা’। পরবর্তীকালে এদের সাফল্য ও প্রেরণায় আরো বেশ কয়েকটি দেশীয় রেকর্ড কোম্পানির জন্ম হয় যেমন- পাইওনিয়ার, ভারত, রিগ্যাল, মেল-ও-ডি এবং কোহিনূর। দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই দেশি কোম্পানিগুলো সাফল্যের মুখ দেখেছিল।

গ্রামোফোন বা কলের গান ৮০ বছরের ইতিহাসে এক মহা গৌরব ও অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। গ্রামোফোনকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সংগীতশিল্পী সৃষ্টি হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন— গওহর জান, লালচাঁদ বড়াল, কে মল্লিক (কাশেম মল্লিক), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বিমল দাশগুপ্ত, তুলসী লাহিড়ী, আব্বাস উদ্দীন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দলাল সায়গল, আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, শচীন দেব বর্মন, কানন বালা দেবী, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, বেগম আখতার, সুধীর লাল চক্রবর্তী, কমলা ঝরিয়া, জগন্ময় মিত্র, যূথিকা রায়, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এবং আরো অনেক শিল্পী।

জ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির ফলে নতুন প্রযুক্তির কাছে হার মেনে কলের গান বেশ কয়েক দশক আগেই বাঙালির জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। এখন শুধু স্মৃতির বেদনা হয়ে পড়ে আছে কলের গান। অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতির যুগে গ্রামোফোন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নব প্রজন্ম আর প্রকৃত গ্রামোফোন বা কলের গান চিনবে না। বাংলার ঘরে ঘরে কলের গান আর কখনো বাজবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads