• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

অনুবন্ধ

  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯

শ্রাবণী প্রামানিক

 

আমার অবাক চোখ খুশিতে ভরে উঠতে সময় লাগলো না। বাবার কথাটা শোনার পরে মনে হলো, আমি এরকমই কিছু চাই মনে-প্রাণে! আমি চোখে-মুখে নরম সূর্যের আলো মেখে বাবার ঘর থেকে যেন উড়তে উড়তে হেঁসেলে এলাম। চেনা ছবি হয়ে মা উনুনের পাড়ে পিঁড়িতে বসা। পদ্মাও গত সকালের পুনরাবৃত্তিতে মায়ের কিছুটা দূরে নতমুখী স্থির দৃষ্টি। কাজের পরিণাম ভাবার জন্য মস্তিষ্কে যে সময়টুকু লাগে আমি নিজেকে সেটা দিলাম না। দৌড় পায়ে হেঁসেলে ঢুকে দুই পায়ের পাতায় ভর করে বসে পেছন থেকে পদ্মার গলা জড়িয়ে ধরেই বলতে শুরু করলাম। ও যে লহমায় কেঁপে উঠে চমকে ঘার ঘুড়িয়ে তাকালো আমার চোখে; আমি দেখেও দেখতে চাইলাম না। বুঝলাম মাও বেশ অবাক হয়েছেন! তবে মা একজন মা বলেই জানেন যে, তার কন্যা মুখ খুলবে এবং তখন তিনি সব জানতে পারবেন। মা আমার দিকে তাকিয়ে পলক না ফেলা চোখেই আবার ফিরলেন আলু-পেঁপের তরকারিতে। আমার স্বরের উল্লাস মাকে আবার আমার দিকে তাকাতে বাধ্য করলো। মা জানেন, বাবা এইমাত্র আমাকে ডেকে বললেন; পদ্মাকে আমার সঙ্গে কলেজে নিয়ে যেতে... আর ফেরার সময় ওকে আমাদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে! আমি-ই হেড মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলব।

মা কিছু না বলেই আবারো হাতা-খুন্তিতে ফিরে গেলো। আমি যেন অবাক হতেও ভুলে যাই! খেয়াল-ই করিনি, আমার দুই হাতে এতক্ষণ পদ্মার গলা জড়িয়ে ধরা। ও যখন আলতো হাতে ছাড়িয়ে দিচ্ছে আমার হাত, তখনই বুঝলাম। তবু আমি শুনতে বা বুঝতে চাইলাম না; পদ্মা বা মা তাদের আচরণে আমাকে কী ইঙ্গিত করলেন! গলার স্বর অবিকল রেখে, মা আমাদের সঙ্গে তাহলে পদ্মাকেও ভাত দিয়ে দেন...পদ্মা চল, এখনই একটু তৈরি হয়ে নিতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে পদ্মার ডান হাত ধরে একটানে ওকে দাঁড় করাই। মাকে দেখে মনে হলো মা ছাড়া এই ঘরে আর কেউ নেই। আমি পদ্মার হাত ধরে হেঁসেল থেকে সোজা আমাদের খোঁয়াড়ে এসে ফুলদির সামনের চৌকিতে বসলাম এবং আমার হাতের মুঠোয় ধরা পদ্মার হাত ছেড়ে দিলাম। আমাদের দেখে ফুলদি সোজাসুজি প্রশ্ন সূচক তাকালো। আমি উত্তর দেবো বলে গলা খানিক ঝেড়ে পরিষ্কার করলাম— ফুলদি, পদ্মা আজ আমাদের সরকারি স্কুলে ভর্তি হবে, বলেই আমি পদ্মার দিকে পূর্ণ চোখে তাকাতেই ওর চোখ যে ছলছল!

হাঠাৎ-ই ফুলদি কেমন খলবলে হয়ে ওঠে, বাহ! এত চমৎকার খবর! বাহ, বাবা খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!...  আচ্ছা... আচ্ছা...

আমি বুঝি, ফুলদি মনে মনে কোনো বিষয়ের হিসাব মিলিয়ে নিচ্ছে দ্রুত! আমার ভাবনার গাড়ি না থামতেই  আবার কথা শুরু করে ফুলদি, সহেলি তুই তো যাচ্ছিস পদ্মাকে নিয়ে... যা, আমি তো যেতে পারছি না। তবে আমার পাটের ব্যাগটা তোকে আমি আজ কলেজে নিতে দেবো... আর... আর পদ্মাকে লাল পাড় হলুদ শাড়িটাও পড়তে দেবো।

আমি হতবাক হই, তোমার সবচেয়ে প্রিয় দুটি জিনিস তুমি আজ আমাদের ব্যবহার করতে দেবে? তোমার কী হয়েছে ফুলদি?

— ভাবিস না এমনি দিচ্ছি, তোদের পছন্দ করি তাই দিচ্ছি!

ফুলদির মুখ যেন তার প্রিয় শাড়ির লাল-হলুদে মাখামাখি! বিশ্ববিদ্যালয় কী ফুলদিকে আমূল বদলে দিলো! আমি ফুলদির বদলে যাওয়ার কারণ খুঁজছি অ্যালজাবরার সূত্র মিলিয়ে। কিন্তু নুয়া আপা এসবের কিছু না জেনেই বারান্দায় ফরাস বিছিয়ে ডাকতে শুরু করলো— আমি ভাত দিয়েছি... ছোটো...।

আমার সূত্রে প্যাঁচ লাগে। অ্যালজাবরার খাতা বন্ধ করে আমি আবার পদ্মার হাত ধরি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো জোর না করলে পদ্মাকে স্কুল পর্যন্ত নেওয়া কঠিন কাজ হবে! লম্বা ফরাসে আমাদের বসার জায়গা রেখে দাদাভাই আর বাবা খেতে বসেছেন। যথারীতি নুয়া আপা খাবার পরিবেশন করছে আর মা হেঁসেলে। আমি সচেতন খেয়ালে দেখি— দাদাভাই আর পদ্মা যেন পণ করেছে, কেউ কারো দিকে দৃষ্টির ছায়াও ফেলবে না! পদ্মা আমাদের বাড়ির প্রথম এবং একমাত্র বউ। তবে এই মুহূর্তে যে কেউ বলবে, পদ্মা এ বাড়ির বউ তো নয়! তবে হতে পারে, এই বাড়ির কৃষ্ণ গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির পরিবর্তিত রূপ!

চিরসত্যের মতো বাবা যখন কালো লম্বা ডাঁটের ছাতা হাতে নিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে পা রেখেছেন; মা এসে দাঁড়ালেন চালতা তলায়। বাবার পেছনে পেছনে যেখানে আমি আর পদ্মা এগিয়ে যাচ্ছি, মা সেই পথে এসে দাঁড়ান। ভেবে নিলাম, মায়ের আমাকে কিছু বলার আছে। কিন্তু মা আমাকে ছাড়িয়ে আমার বাঁ পায়ের দূরত্বে থাকা পদ্মার হাত ধরলেন, এতদিন যে সুযোগ পাওনি, আজ পেয়ে তা হেলায় হারানো ঠিক হবে না। সময় তোমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা কে বলতে পারে? তাই সবচেয়ে মূল্যবান সুযোগ যেন তুমি কাজে লাগাতে পারো, এই দোয়া করি।

ঘোমটা পরা মায়ের চিরচেনা মুখ আমার কাছে তারায় তারায় ভরা অন্ধকার আকাশের মতো রহস্যময় মনে হয়! বাবাও কি আমার মতোই ভাবছেন?  না হলে চলা থামিয়ে মায়ের মুখের দিকে গভীর করে তাকিয়েছেন কেন? ফুলদি আর নুয়া আপা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দাদাভাই? সে কোথায়? আজ যে শীতের সকালে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টির মতো অন্যরকম এক সকাল।

এই অন্যরকম সকালটার অর্থ হয়তো এতক্ষণে পদ্মার অনুভবে আঘাত করলো। ফলস্বরূপ বাবা এবং মায়ের পা ছুঁয়ে দিয়ে দোয়া আদায় করে নিলো। দৃশ্যটা আমার মগজে গেঁথে গেলো অকারণ এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মন তুলনামূলক প্রশ্নপর উত্তর দিতে থাকলো ঝটপট— আজ নুয়া আপার হাত না ধরেই পিঠে আলতো স্পর্শ ছাড়াই পদ্মা সালাম করতে পেরেছে! তবে কী পদ্মা অন্তরে অন্তরে দাদাভাইয়ের সত্যিকারের বউ হয়ে উঠলো?

আমাদের কলেজে মেয়ে শিক্ষার্থী হাতে গোনা এবং মুখ চেনা। তাই একবার তাকালে ফিরে আবার দেখতে হয়, এমন চেহারার পদ্মাকে নিয়ে বেশ বিপদ হলো। যারা সচরাচর কথা বলে না, পদ্মা সম্পর্কে তাদেরও প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হলাম! জোহরের বিরতিতে পদ্মাকে নিয়ে দিলালপুরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হেড মাস্টার মশাইয়ের টেবিলের সামনে যখন পৌঁছেছি, আমাদের দুজনের শরীরমুখ রোদে ঘামে জবজবে...লালে লাল। এই স্কুল ছেড়েছি এখনো দুই বছর হয়নি। তাই আমার মুখ খুব চেনা মাস্টার মশাইদের কাছে।

পদ্মার অক্ষর জ্ঞান এতো প্রখর যে হেড মাস্টার মশাইয়ের মতো আমিও চমকে উঠলাম! কোনোদিন স্কুলের আঙিনায় পা না দিয়েও যে কেউ এতো ভালো পড়তে পারে এটা আমার জানার বাইরে ছিলো। আমার হঠাৎই মিলনকে অনেক বড় মাপের মানুষ বলে মনে হয়।

যদিও পদ্মা ভীত ছিলো খুব। প্রথম প্রথম গলা কিছু কাঁপছিলো, কিন্তু তারপর আর নয়। হেড মাস্টার মশাই ওর পড়ার ধরন দেখে ছয় ক্লাসের বাংলা আর ইংরেজি পড়তে দিলে, পদ্মা তাতেও উৎরে গেল হেসে-খেলে! আমার খুব খুব আনন্দ হলো। কিন্তু হেড মাস্টার মশাই যখন পদ্মার জ্ঞান এবং বয়স বিবেচনায় তাকে ক্লাস সেভেনের উপযুক্ত মনে করলেন, আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads