• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

শৈলকূপার তিন গ্রামে গণহত্যা

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

বঙ্গ রাখাল

 

 

১৯৭১ সালের ১ জুলাই ভোর হওয়ার আগেই তিনদিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ছোটবোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর গ্রামটি ঘিরে ফেলে। পার্শ্ববর্তী ৫ নং ইউনিয়ন কাঁচের কোলের জামায়াতে ইসলামীর নেতা মওলানা মোশাররফ হোসেন, শ্রীরামপুরের মুসলিম লীগার ও শান্তি কমিটির শফি উদ্দিন আহমেদ, শেখপাড়া গ্রামের শের আলী মেম্বার এই অভিযানের সঙ্গে জড়িত বলেও তথ্য পাওয়া যায়। সে সময় বসন্তপুর গ্রামটি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে এবং মুক্তিবাহিনীর গ্রাম বলেই সর্বাধিক পরিচিত ছিল। তাই রাজাকারদের তথ্যের ভিত্তিতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মিলিটারি বাহিনী মদনডাঙ্গা বাজারে তাদের গাড়ি রেখে, গ্রামগুলোর পূর্ব, পশ্চিম. দক্ষিণ দিক এসে ঘিরে ফেলে দীর্ঘ সময় ধরে ফায়ার করে। সেদিন এই গুলির আঘাতে বড় বড় গাছগুলো পাতাশূন্য হয়ে পড়েছিল। এবার তারা শুরু করে বাড়ি বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার অভিযান। সাধারণ মানুষের উপর শুরু হয় নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন। এই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে রাইফেল আর রাজাকারদের হাতে থাকত দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী গ্রামের ভেতর প্রবেশ করলেই গ্রামের মানুষ তাদের জীবন রক্ষার জন্য বনবাদাড়ে আশ্রয় নেয়। লোকজনের মধ্যে তখন এক ধরনের ভয়ভীতি এবং আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। যে কারণে এ হত্যাকাণ্ডে শহীদদের কবর দিতে গিয়েও এই সহজ-সরল মানুষ বারবার লাশ রেখে পালিয়ে গেছে। তারা পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকার বাহিনীর ভয়ে পাট, আখ ও ধান ক্ষেতের মধ্যে নিজেকে আড়াল করতে গিয়েও হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। আবার কেউ কেউ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাগান, জলশূন্য পুকুর, ওপারের রতনপুর বা রতিডাঙ্গা গ্রামে আশ্রয় নেয়। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি বাহিনী ছোটবোয়ালিয়াকে বসন্তপুর মনে করে এবং প্রথমেই পাটের ক্ষেতের কাছে হাশেম, কাশেম ও ধানের চারার মধ্যে মনোয়ার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের বাড়ির নিচে ওহেদ মণ্ডলের স্ত্রী এবং সৈয়দ মাস্টারের স্ত্রীকে পাকিস্তানিরা ধর্ষণ করে। তাদের সুপারিশ করতে গেলে ইরফানকেও সেখানে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে। ভাই মনোয়ারকে অত্যাচার করার কথা শুনে অন্ধ হুরমত ভাইয়ের কাছে গেলে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ছোটবোয়ালিয়ায় আনোয়ার শেখের কোলের পাঁচ মাসের মেয়ে শিশুকে কেড়ে ফেলে দেওয়া হয় ক্যানেলের ছলছলে পানির মধ্যে এবং তাকে সেদিন লাইফেল দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।

ছোটবোয়ালিয়ার আরেক মহিলা জোহরা বেগম, তাকে মিলিটারিরা তাড়া করলে তিনি শাড়ি ফেলে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে চর শান্তিডাঙ্গায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তবে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে তার শাশুড়ি ও ননদ। তাদের রাইফেল দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে সারা শরীর ফুলিয়ে দেওয়া হয়। বর্বরোচিত এদিনে গুলি লেগে আহত হয় ছয়জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে জীবিত আছেন নিধিরাম প্রামাণিক ও প্রবোধ বিশ্বাস (তুলসে)। তাদের শরীরে এখনো তারা বহন করছেন সেই দুঃখ দিনের করুণ স্মৃতি। তাদের পাখির  মতো নিশানা করে গুলি করা হয়। আলমডাঙ্গার ময়েন উদ্দিন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে মাথায়  গুলি লেগে আহত হয় এবং বাক্রুদ্ধ অবস্থায় তিন মাস পরে মারা যায়। জবেদ আলীর পায়ে এবং চাঁদ আলী সরদারের ডান হাতে গুলি লাগলে সে এভাবেই জীবনযাপন করে মৃত্যুবরণ করে। জয়ন্তীনগরের সুশীল বিশ্বাসের ঘাড়ে গুলি লাগলে বাইরে থেকে শরীরের ভিতরের সব দেখা যাচ্ছিল। সে এক বীভৎস দৃশ্য!

বসন্তপুর গ্রামে সেদিন প্রতি ঘরে ঘরে অভিযান চালানো হয় এবং যুবক, বয়স্কদের ধরে বসন্তপুর হাইস্কুল মাঠে জড়ো করে। তাদের বাঁশের লাঠি, রাইফেল আর বুট দিয়ে বেধড়ক পিটানো হয়। এ সময় বেয়নেট দিয়ে অনেককেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আহত করা হয়। কিছু লোককে পিটাতে পিটাতে মোশাররফের বাড়ির কাছে নিয়ে যায় এবং জানতে চায় মোশাররফ কোথায়। সে সময় বসন্তপুরের অনেক মেয়েদের সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই গ্রামের আকবর আলী মোল্লাকে পরনের গামছা খুলে বিবস্ত্র করে হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে পিঁপড়ার গাদির ওপর ফেলে রাখা হয়। যখন গ্রামের নিরীহ মানুষকে বুট, লাঠি দিয়ে একের পর এক নির্যাতন করা হয়, তখন শ্রীপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শফি উদ্দিন আহমেদ সেখানে আসে এবং নির্যাতিতদের মধ্য থেকে ৫০ জনকে রাজাকারে নাম লেখানোর শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়। বসন্তপুর স্কুল মাঠে অত্যাচার করার সময় সবার মধ্য থেকে তারা মো. আত্তাফ মোল্লা, মো. হাফিজ মোল্লা, মো. শাহজাহান মোল্লাকে আলাদা করে এবং তাদের ওপর চলে অত্যধিক নির্যাতন।

পাকিস্তানি মিলিটারি ফিরে যাওয়ার সময় তারা মো. আত্তাফ মোল্লা, মো. হাফিজ মোল্লা ও মো. শাহজাহান মোল্লাকে নিজেদের সঙ্গে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। তাদের হত্যা না করে তিনদিন পরে কারাগারে পাটিয়ে দেয়। মো. আতাহার মাস্টারের কাছ থেকে অন্য একটি তথ্যে জানা যায় যে, এই গ্রামের একটি যুবতী মেয়েকে তার মা-বাবার সামনে ধর্ষণ করা হয়েছিল। মেয়েটি সেই অপমানে এই গ্রাম ছেড়েছে আর কোনোদিন বসন্তপুরে ফিরে আসেনি। এভাবেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী এই গ্রামগুলোর মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। কিছু নারী বিবস্ত্র হয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তারা শুধু অত্যাচার, নির্যাতন করেই শান্ত থাকেনি লুটপাটও করেছে। শাহজাহান মোল্লা, হোসেন মোল্লার বাড়িতে গিয়ে টাকা, পয়সা, গহনা লুটপাট করেছে। শাহজাহান মোল্লার ঘরে টানানো শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা লেখা ছবি যা পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা দেয়াল থেকে নামিয়ে পায়ের নিচে ফেলে দলিথ-মথিত করে তছনছ করেছিল।

কিন্তু বাঙালির এই বীরত্বের ইতিহাস আমরা যতটুকু অনুভব করতে পারি, সে তুলনায় অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্মমতা, লাঞ্ছনার ইতিহাসের প্রকৃত চিত্র অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারি না। কারণ আমাদের সামনে সেই ভয়াল দিনের ভয়াবহতার চিত্র সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। বরং সঠিক চিত্রকে বার বার গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। জানানো হয়নি নতুন প্রজন্মের কাছে এই গৌরবগাথার পেছনে রয়েছে অনেক প্রাণের বিসর্জন আর মা-বোনের ইজ্জত হারানোর করুণ আর্তনাদ।

ছোটবোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর গণহত্যায় তারা প্রায় ১৯-২০ জন স্থানীয় নিরীহ মানুষ ও শরণার্থীকে হত্যা করে। ছোটবোয়ালিয়া, জয়ন্তীনগর, বসন্তপুর গণহত্যা— এই তিন গ্রাম নিয়েই বিস্তৃত। এই তিন গ্রামের নিরীহ মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে হত্যা করা হয়নি। তাই এই গণহত্যাটির নাম বসন্তপুর গণহত্যা নামে সমধিক পরিচিত হলেও আমরা একে নির্দিষ্টভাবে বসন্তপুর গণহত্যা বলতে পারি না। বরং উক্ত তিন গ্রামের উল্লেখ করেই গণহত্যাটির নামকরণ করা উচিত বলে মনে করছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads