• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

বিদ্যাসাগর ও আজকের প্রজন্ম

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ০৩ অক্টোবর ২০২০

তখন আর এখনকার কাল এক নয়। দুইশ বছর পেরুল। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবর্ষ, কাল গুনলে দিবসরজনীর মাপে খুব বেশি সময় নয় হয়তো। কিন্তু মানব জীবনের হিসেবে তা নেহাত কম বলি কী করে! তবে প্রশ্ন, এতদিন পর কেন বিদ্যাসাগর? তাঁকে কী শ্রেষ্ঠ মানুষ ভেবে, একপ্রকার বিশাল দেবমূর্তি বানিয়ে, ভক্তির ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য— নাকি তাঁর কর্ম-পরিধি, কর্মের ও পাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন যাচাইপূর্বক, আধুনিক শিক্ষার দ্বীপ জ্বেলে তিনি যে অন্ধকার দূরীভূতকরণের দায়ে, সত্য-মিথ্যা, সংস্কার-কুসংস্কারের সীমানা অতিক্রম করে মানবজাতির জন্য এক বিক্ষত প্রতিজ্ঞার ভার কাঁধে নিয়েছিলেন— নিরন্তর তীব্র হয়ে উঠেছিলেন— সে কারণে! তিনি তো এখনো আছেন প্রজন্মান্তরে, চলমান, কে-না জানে বিদ্যাসাগর কে ছিলেন? স্কুল পাঠ্যবইয়ে, উচ্চশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের পঠন-পাঠন তো এখনো উবে যায়নি। তবে বরঞ্চ প্রশ্নের চেয়ে জিজ্ঞাসাটা এখন শক্তিশালী হতে পারে— তাঁর মতো চিন্তার দার্ঢ্য-দৃঢ়তা কিংবা কথা ও কাজের মিল— আর সেটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি যে বরাবর দুর্মর সাহস দেখিয়েছেন— সেটা কতটা সম্ভব, অন্তত একালে বা তা কজনের রয়েছে! আমরা কতটা তাঁর চর্চা করতে পারছি? এমন সহজলভ্য সমাজে বিদ্যাসাগরের কাজ বা দৃষ্টি তো পরিপ্রেক্ষিত পাওয়ারই কথা। সেটা কতটা পাচ্ছে! বস্তুত তিনি যে সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন, সেটা প্রচণ্ড স্ববিরোধী ও সদ্য বিকাশমান পুঁজির দাপটময় চঞ্চল সমাজ। মধ্যবিত্তের তখন গজাচ্ছিল ‘দাড়িগোঁফ’। তারা প্রায়শ তেতে উঠছিল, পরিবর্তনের তাড়নায়। আবার যখন দেখা যাচ্ছিল পরিবর্তনের ওপারে নিজের পরিবর্তন দরকার তখন সুযোগ বুঝে লেজ গুটিয়ে পালিয়েও যাচ্ছিল। বিদ্যাসাগরের জীবনাচরণের ভেতর দিয়ে এসব উঁকিঝুঁকি আমাদের চোখে পড়ে। আস্তিক-নাস্তিক, ঈশ্বরবাদী-নিরীশ্বর, ডিরোজিওপন্থা বা নিছক বস্তুবাদী, ভাববাদী, ধর্মরক্ষা, সমাজরক্ষা— এমন নামে-বেনামে অনেক প্রবণতা ওই সমাজে বিছানো ছিল। বিদ্যাসাগর ঘরে-বাইরে দেখছিলেন সব। কী করবেন তিনি? কী চান তিনি! এসবের মাঝে নিজেকে ঠিক কোন পরিমার্জনা দেবেন বুঝে ওঠা কঠিন ছিল। তিনিও যাদের ওপর ভরসা করেন, পান না তাদের সময়মতো, পেলেও পিছিয়ে যান, এগিয়ে চলেন, পিচ্ছিলতায় গড়ানো জীবন। বস্তুত, তিনি চলতি সমাজে দূরে বা কাছে কারোরই ভালো হতে পারেননি, আস্থাভাজনও হননি। দৈনন্দিন চলতি সমাজ ব্যবস্থার ভেতরে তিনি ছিলেন ‘জঞ্জাল’— একক, আলাদা। ব্রিটিশ-শাসক বা এদেশের পণ্ডিতপ্রবর মহল তাকে কিছুতেই গ্রহণ করতে চাননি। সেটি চাওয়ার কথাও নয়। কাজেই, লড়তে হয়েছে—এক অর্থে— একাই, এক হাতে, মুখোমুখি হতে হয়েছে সর্বপ্রকার শক্তির বিরুদ্ধে; সে কারণে বিশ্বাস ও আস্থায় তাঁকে পরিষ্কার ও দৃঢ় হতে হয়েছে, কেউ যেন অযথা ভুল ধরতে না পারে, আর ভুল ধরলেও তা যুক্তিতে যেন ধরাশায়ী হয়। ফলত যে মতের পণ্ডিতই হোক, কেউ তার কাছে দৃঢ় হতে পারেননি।

 

২.

মুখ ব্যাদান করে সেই প্রশ্ন : ‘বিদ্যাসাগর আজকাল কেউ পড়ে!’— এভাবে সমাজশূন্য প্রশ্নজ্ঞাপক সমীকরণের ডানপাশে কী বসতে পারে? এ সমাজে বিদ্যাসাগর কি তবে করুণার পাত্র? যদি তিনি করুণার পাত্র হন তবে করুণানিধান কে?

উনিশ শতকের সমাজ ছিল উৎকণ্ঠিত। আর এখনকার সমাজ উগ্র-ভোগবিলাসিতার নখরে বিলাসিতার গহ্বরে নিপতিত। এ বিলাসিতার পেছনে আছে কদর্য নীতিহীনতার প্রহেলিকা। মূলত, এরাই সমাজের চালিকাশক্তি। বলছি, গত কয়েক দশকে পুঁজির প্রশ্রয়ে উঠে আসা অপরিশোধিত বাঙালি মধ্যবিত্তের কথা— যে পুঁজির সংশ্রব এদের ভেতর কাঠামো রচনা করেছে। নিছক জৌলুস ও অক্ষম ক্ষমতার দাপুটে অহংকারে তার সবটা গড়া। সেটি খুব পিচ্ছিল। কাঠামোও দুর্বল। বিদ্যাসাগরের উনিশ শতকে দুটো বিষয় ছিল : এক. শাস্ত্রাচারী পণ্ডিতপ্রবরদের উৎপাত; দুই. সঞ্চালিত উপনিবেশ-পুঁজির মধ্য থেকে উঠে আসা নব্য-মুৎসুদ্দি পুঁজি শ্রেণি। এই পুঁজি শ্রেণি গোলমেলে দশায় সমাজের ভরকেন্দ্রেরূপে অধিষ্ঠিত ছিল। মূলত, বিদ্যাসাগর উভয়ের কাছেই তার মননশীল যুক্তিনির্ভর নীতি দ্বারা পরাস্ত ছিলেন। বলে নিই, বিদ্যাসাগর ‘অতিমানব’ নন। তিনি কোনও রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন না। উনিশ শতকী সমাজে ভাবাবেগের যে প্রাবল্য সেখানে যুক্তির আঘাত এবং প্রতিরোধ ছিল খুব কঠিন। কারণ সমাজ-কাঠামোটি ছিল এক ভাবাদর্শের মোড়কে আবদ্ধ। বিদ্যাসাগর সমাজ-কাঠামোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে আঘাত করতে চেয়েও তেমন পারেননি। বরং প্রত্যাঘাত এসেছে, নানাভাবে। শাস্ত্রাচারি পণ্ডিতরা বেঁকে বসেছে, তারা অপবাদ দিয়েছে, স্বীয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও উপস্থিত মুহূর্তে সরে গেছেন— একথা আগেই বলেছি। এমনকি পরিবারেও তার সদ্ভাব বজায় থাকেনি। তিনি অভিমানে বীরসিংহ ছেড়ে এসেছেন, এক পর্যায়ে কলকাতা থেকেও সরে যান— আশ্রয় নেন সাঁওতালপল্লিতে। এই সরে যাওয়াটা কেন? বিদ্যাসাগর তো নীতিগতভাবে পরাস্ত হননি। নিজের জন্যও কিছু করেননি। আর কর্মক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের ঢেউ তো নানারকমের। বস্তুত ভাবাদর্শের কাঠামোটি ভাঙার ক্ষেত্রে একক প্রচেষ্টা তার তেমন না দাঁড়ালেও ঝাঁকুনি তো দিয়েছিলেন। এই সমাজ-অভিঘাতের বিপরীতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ওই সময়ে যে ভাবাবেগের অন্তঃস্রোতে উদার-মানবতার দৃষ্টিকোণ তৈরি করছিল তা সকলেই প্রায় মেনে নিল এবং তাতে প্লাবনও আসল। কেন? এ দুটোর পার্থক্য কী? এ তো এপিঠ-ওপিঠ। একটি আবেগপ্রসূত ভাবাবেগ— যেটা ধর্মাশ্রিত, রূপকল্পময় আর অন্যটি যুক্তিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজ প্রথমটি বিনা দ্বিধায় ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। ওই শাস্ত্রাচার-প্রলুব্ধ যুক্তিহীন, ক্ষমতাশালী লোভাতুর অংশটিও তাতে প্রবলভাবে সায় দেয়, প্রশ্রয়ও দেয়। কারণ এর সাথে রাজনৈতিক-পুঁজিও যুক্ত হতে দ্বিধা থাকে না। আমরা জানি, বিদ্যাসাগরের বিবাহ-সংস্কার একপর্যায়ে ব্যর্থই হলো। তিনি ‘একক’ হয়ে পড়লেন। দার্ঢ্যশীল, অভিমানী বিদ্যাসাগর মনন ও যুক্তির সারার্থে শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রকে প্রত্যাঘাত করেছিলেন কিন্তু আভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলো ঠিক মুছে দিতে পারলেন না। যে তেজ ও বিক্রম ছিল তার ব্যক্তিত্বে— তা বাস্তবতার আঁচে গড়া— সেখানে মন্দিরের ব্রাহ্মণ্য-শাস্ত্রসাধকরা তাৎক্ষণিক পিছু হটেছেন, প্রশ্নশীল হয়েছেন, সমর্থনও দিয়েছেন কিন্তু ক্রমবর্ধমান অনায়াসলব্ধ উৎপাদনশীল বেনিয়া পুঁজির আগ্রাসন তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে—তা পরাস্ত হয়ে দীর্ঘ সংস্কারাশ্রিত ভাব-কাঠামোয় প্রত্যাবর্তন এনেছে; সেখানে ক্ষমতা, লোভ আর উটকো আবেগের জৌলুস প্রশ্রয়ও পায়, যুক্তি-বুদ্ধির জায়গার আবেগের শাসনই তখন বড় হয়ে ওঠে। ফলে তখনকার কলকাতার সমাজে এ এক ‘অসমর্থিত’ মানুষ ক্রমশ আত্মগ্লানিতে নুয়ে পড়ছে যেন। স্ববিরোধিতা আর সন্ত্রাসের যে সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করল— যা তাঁর সামনেই গড়ে উঠেছিল— সেখানে থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। আর এ প্রত্যাহার তার ব্যক্তিত্বের সৌম্য-সমাহিত চিন্তার নির্ণায়ক। এ এক নিয়তিও বটে।

এখন প্রশ্ন, এই অন্তরীণ সমাজ-কাঠামোর অন্ধকার স্তরগুলো আজকাল কী তবে কেটে গেছে? বণিকের শোষণ তো গেছে। পূর্ব-বাংলা এখন স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ। উপর্যুক্ত সমাজ-ব্যবস্থার কঠোর-কঠিন শৃঙ্খল আর যুক্তির ও আবেগের যুযুধান যে চলছে— সেখানে কে অগ্রবর্তী— এমন প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? অভিমানী বিদ্যাসাগর তো শেষ পর্যন্ত সাঁওতালপল্লিতে গেছেন, সেই পল্লী কী এখন আছে? বা ওই আদিবাসীদের সরল মনের প্রক্ষেপণ এখন কেমন? সবকিছুই তো বদলায়। মনের ভেতরের চলতি অভিজ্ঞতার যে রেখাপাত সেটি একক তো নয়— অবশ্যই সামষ্টিক। সেই সামষ্টিক শর্তেই সমাজ বদলেছে। তার উপরিতল বা অন্তর্কাঠামোও রচিত হয়েছে। আমরা জানি, বাস্তবতার ভেতরে গড়ে ওঠে বিবর্তমান সমাজের নানা অভিমুখ। এই অভিমুখসমূহ দ্বন্দ্বসংকুল। এই দ্বন্দ্ব থেকে উনিশ শতকের চিন্তা-দর্শনের শক্তি সমাজে তৈরি হয়েছে। যেটি এই একুশ শতকে মানবিক অবক্ষয়ের প্রান্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে কথা আর পুনর্ব্যক্ত করবার প্রয়োজন নেই। বিদ্যাসাগর-চরিত্রের একটা প্রধান দিক তার চিন্তার স্বচ্ছতা। সেখানে কোনো সংশয় ছিল না। দীর্ঘদিনের সমাজে গেঁথে থাকা শাস্ত্রের সংস্কারের জন্য জড়তামুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো পিছুটানও ছিল না, সেজন্য যে উত্থিত পুঁজির উদ্ভিদ্যমান ব্যক্তির ভেতর-চালাকি, দোলাচলতা, চাতুরিপনা, গোঁড়ামি, ভয়াচ্ছন্ন আচরণের কূটকৌশল এসব মোকাবিলায় তিনি অপ্রস্তুত হয়েছেন, কুণ্ঠিত হয়েছেন, নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিও এসেছে তার মধ্যে কিন্তু ক্রমশ তিনি জীবন দিয়ে তা স্বীকারও করে নিয়েছেন, ফলত তাতে হয়তো নিয়ত একাকী হয়ে গেছেন কিন্তু পরাস্ত হননি, তাবৎ বাস্তবতা মেনে প্রগতির কথাই বলে গেছেন। এ প্রগতি মানুষ ও সমাজের পক্ষে, জড়তা কাটিয়ে সম্মুখগামী আলোর পথে। দ্বিতীয়ত, পড়াশোনায় তার নিখাদ পাণ্ডিত্য ছিল। এই পাণ্ডিত্য সংস্কারমুক্ত এবং আধুনিক। ফলে তা শাস্ত্রাচার বা উপাসনালয়ের ভজনায় আবদ্ধ ছিল না, সবকিছু বুঝিয়ে নিয়েছিলেন প্রখর মনোবল ও বুদ্ধির তীব্রতা দিয়ে। এই আলোর কণিকা ক্রমাগত আঁধার কাটিয়ে অপ্রতিরোধ্যতা মোকাবিলা করে সম্মুখের দিকে এগিয়ে গেছে। এ পথটি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কখনো তা বিজনে হয়েছে ব্যতিক্রম কখনোবা স্বার্থবুদ্ধির রোষানলে প্রতিরোধের বৃত্ত পেরোতে গিয়ে হয়েছেন বাধার সম্মুখীন। কখনোবা অগ্রবর্তী আশার আলোও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ আলোর উষ্ণতা বা শক্তি বিকিরিত হয়ে ক্রম-পরিবর্তনমান সমাজে এনেছে রূপান্তর। এ পরিবর্তনের রূপরেখা এমন যে একালেও তা বিকশিত এবং অরুণ-আলোয় রঞ্জিত।

কার্যত উনিশ শতকের জায়মান অর্থনীতির ভেতর থেকেই বিদ্যাসাগরের অনন্যতার স্বরূপ চিহ্নিত হয়েছিল, সেটি আগ্রাসী অর্থনীতির চাপে হয়তো দুর্বিনীত কিন্তু তার প্রকাশ চাপা পড়ে থাকেনি। এখনে জৌলুসটা বাইরের কিন্তু অন্তরের অবরুদ্ধতায় জমাট অপচয় ঘিরে ফেলেছে পুরনো কৌলীন্যের কঠোর প্রাচীর— সেটা ভাঙতে হবে ওই প্রগতি দিয়েই। বিদ্যাসাগর যা অকপটে বলে গেছেন এবং তার জীবৎকালের অভিজ্ঞতাকে আমাদের সাহস ও সত্য দিয়ে তা বুঝে নিতে হবে। তার কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads