• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

বর্ণপরিচয়ের বিদ্যাসাগর

  • প্রকাশিত ০৩ অক্টোবর ২০২০

কুমার দীপ

 

 

আমাদের দেশে যারা লেখক, তাদের কেউ কেউ শিক্ষাসংস্কার ও সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন বটে, কিন্তু এঁদের কেউই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাথে তুলনীয় নন; এ-ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবস্থান অবিসংবাদিত ও একক। 

একসময় আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের শৈশব শিক্ষাটা শুরু হতো গ্রাম্য পাঠশালায়, যেখানে আমাদের পণ্ডিত মহাশয়েরা দুটো অনিবার্য পুস্তিকা পড়াতেন— ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ ও ‘বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ’। লাল মলাটের খুব পাতলা দুটো বই। প্রথম ভাগটি বোধকরি হালকা লাল, আর দ্বিতীয় ভাগটি গাঢ় লাল। ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে চল্লিশ বছর আগে এক-একটি বইয়ের চার আনা বা আট আনা দাম ছিল বোধহয়। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের প্রথম প্রকাশকাল পহেলা বৈশাখ ১৯১২ সংবৎ-এ এবং দ্বিতীয় ভাগের প্রথম প্রকাশ ১লা আষাঢ় ১৯১২ সংবৎ। উল্লেখ্য, ‘সংবৎ’ ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে বহুল ব্যবহূত একটি বর্ষপঞ্জি, রাজা বিক্রমাদিত্য ৫৬ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে এটির প্রবর্তন করেন। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি থেকে এটি ৫৬ বছরের অধিক প্রাচীনতর ও অগ্রবর্তী। শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা প্রণীত এই পুস্তিকা দুটি লেখকের জীবদ্দশাতে যথাক্রমে ষষ্ঠীতম বা ৬০বার এবং দ্বিষট্টিতম বা ৬২বার সংস্করণ হয়েছিল। আমরা জানি, ‘বিদ্যাসাগর’ তাঁর প্রাপ্ত উপাধি আর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বংশগত পদবি, কিন্তু বিভিন্ন স্থানে তিনি ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা’ স্বাক্ষর করতেন।

 

প্রথম ভাগ

অসংযুক্ত বর্ণ। এখানে আছে ১২টি স্বরবর্ণ (লি-কারসহ) এবং ৪০টি ব্যঞ্জন বর্ণ। ব্যঞ্জনবর্ণ অংশে দুটি ‘ব’ আছে, তবে ‘ক্ষ’ নেই। ‘ক্ষ’ যেহেতু ক+ষ এর মিলনে গঠিত হয়, তাই অসংযুক্ত বর্ণের ভেতরে এটি থাকতে পারে না, এই অকাট্য যুক্তিটি ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রত্যেকটি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে একটি করে শব্দ আছে। আছে বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা অংশও। এরপর বর্ণযোজনা অংশে প্রথমে ‘কর’, ‘ঘট’, ‘জল’, ‘অচল’, ‘অধম’... এরকম সরল শব্দ এবং পরে একে একে আ-কার, ই-কার... এভাবে স্বরবর্ণের ‘কার’গুলো যুক্ত করে বিভিন্ন শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এরপর একই শব্দে একাধিক ‘কার’ যুক্ত করে মিশ্র উদাহরণ; অতঃপর অনুস্বারযোগ, বিসর্গযোগ, চন্দ্রবিন্দুযোগ এবং বর্ণবিশেষে উ ঊ ঋ যোগের বিশেষ নিয়মের উদাহরণ আছে। সবশেষে ২১টি পাঠ যুক্ত হয়েছে।

এই পাঠগুলোতে খুব সহজ-সরল বাক্যের মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘কখনও মিছা কথা কহিও না।’, ‘কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না’, ‘রোদের সময় দৌড়াদৌড়ি করিও না।’... এরকম চিরায়ত নীতিবাক্য যেমন আছে, তেমনি গোপালের মতো সুবোধ বালকের গল্প আছে, যে কি না লেখাপড়ায় গভীর মনোযোগের পাশাপাশি বাবা-মায়ের কথা অনুসরণ করে, কারো সাথে কোনোপ্রকার গোলমাল করে না, সবাই তার প্রশংসা করে; আবার রাখালের মতো মন্দ বালকের কথা আছে, যে কি না লেখাপড়া করে না, বাবা-মায়ের কথা শোনে না, সবসময় অন্যের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত থাকে; কেউ তাকে ভালো বলে না। এবং গল্প দুটির শেষে ‘সকল বালকের গোপালের মতো হওয়া উচিত’, ‘কোনো বালকেরই রাখালের মতো হওয়া উচিত নয়।’ বাক্যদুটির মাধ্যমে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। ২১তম পাঠে আছে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যা, অংকে ও কথায়।

 

দ্বিতীয় ভাগ

সংযুক্ত বর্ণ। দ্বিতীয় ভাগের শুরু হয়েছে য-ফলা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। প্রথমে শব্দে, পরে বাক্যে প্রয়োগ। এভাবে সবগুলো ফলা, তথা যুক্তব্যঞ্জনের শব্দ ও বাক্যে প্রয়োগের সুন্দর সুন্দর উদাহরণ দ্বিতীয় ভাগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয় ভাগে পাঠ আছে দশটি, যেখানে যুক্তব্যঞ্জনের প্রয়োগের পাশাপাশি অসামান্য সব নীতিবাক্য ও নৈতিক শিক্ষামূলক গল্প রয়েছে। ‘কখনও কাহাকেও কুবাক্য কহিও না’, ‘যে কুবাক্য কহে, কেহ তাহাকে দেখিতে পারে না’, ‘সদা সত্য কথা বলিবে,’ ‘যে সত্য কথা কয়, সকলে তাহাকে ভালবাসে’, ‘শ্রম না করিলে, লেখাপড়া হয় না। যে বালক শ্রম করে, সেই লেখাপড়া শিখিতে পারে।’ ‘পরের দ্রব্যে হাত দিও না। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে, চুরি করা হয়।’

এ ধরনের চিরন্তন উপদেশ বাক্যের পাশাপাশি রয়েছে যাদব, ভুবন, অভয়, নবীন, মাধব, রাম প্রমুখ বালকের গল্প; যাদের মধ্যে কেউ সৎ আবার কেউ অসৎ গুণের অধিকারী। যে সৎ, তার পরিণতি সুখকর; আর যে অসৎ, তার পরিণতি অসুখকর। কেউ আবার অসৎ গুণ থেকে বের হয়ে কীভাবে সৎ গুণের অধিকারী হচ্ছে, তারও নমুনা আছে। অষ্টম পাঠের ‘পিতা মাতা’ পর্বটি গল্প নয়, উপদেশমালা; পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য কী, তার সারাংশ।

দশম পাঠের ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’ গল্পটি অনন্য। ভুবন নামের এক পিতৃ-মাতৃহীন বালক, মাসির আশ্রিত থেকে বড়ো হতে থাকে। প্রথমদিকে সে অন্য বালকের বইখাতা এগুলো চুরি করছে জেনেও মাসি তাকে কিছুই বলে না। ফলে তার সাহস বেড়ে যেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে বড়ো বড়ো দ্রব্য চুরি করতে থাকে। বহুকাল ধরে চুরি করতে করতে একদিন হাতেনাতে ধরা পড়লে বিচারক তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। শেষ ইচ্ছা হিসেবে ভুবন তার মাসিকে দেখতে চায়। মাসি যখন তার কাছে এসে কাঁদছে, ভুবন তখন মাসির কানে কানে কিছু বলবার কথা বলে একটি কান কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বলে— ‘মাসি! তুমিই আমার ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে তুমি যদি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য তোমার এই পুরস্কার হইল।’ গল্পটি কেবল শিশুদের নয়, শিশুদের অভিভাবকদের জন্যেও অবশ্যপাঠ্য। সময়ের ব্যবধানে আমাদের শিশুরা এখন বর্ণপরিচয় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম-পরিচয় থেকে অনেকটা বঞ্চিত। খুব ছোট্ট শিশুটিকে আমরা এখন নৈতিক শিক্ষার বদলে দেশি-বিদেশি ভাষায় জ্ঞান-সমুদ্র গেলাচ্ছি! তোতাপাখির মতো এসব মুখস্থ করে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ হচ্ছে। অর্থ-বিত্ত-স্বার্থ আর ভোগবাদের মোহে তারা আজ এবং আগামীকে মনুষ্যত্ববিমুখ করে তুলছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads