• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সাহিত্য

অপেক্ষা

  • প্রকাশিত ২৮ নভেম্বর ২০২০

আব্দুস সালাম

 

আলিম সাহেব বেসরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক ছিল। দুই ছেলেকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী সংসারে বেশ সুখেই ছিল। শিক্ষকতা করে সে অল্প টাকা রোজগার করত। তাই সংসারের জন্য তেমন কিছু করতে না পারেনি। তাছাড়া দুই ছেলেকে মানুষ করতে তাকে কম ধকল সইতে হয়নি। ছেলে দুটো ছিল লক্ষ্মী। তারা মা-বাবার অবাধ্য ছিল না। মা-বাবা যা বলত তা-ই শুনত। ছোট ছেলে সায়েম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বড় ছেলে সামী হেল্থ ডিপার্টমেন্টে সরকারি চাকরি পায়। এতে বাবা এতটাই খুশি হয়েছিল যে সারা পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল। সামীকে শহরেই পোস্টিং দেওয়া হয়। গ্রাম থেকে অফিস করতে সামীর কোনো কষ্ট হয়নি। বড় ভাইকে অনুসরণ করে সায়েমও ভালোভাবে পড়ালেখা শেষ করে। চাকরি পেতে তারো কষ্ট হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে এনজিও-তে ভালো একটা পদে চাকরি পেয়ে যায়। দুই ছেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আলিম সাহেবের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়। একসময় দুই ছেলেও বিয়েশাদি করে সংসার শুরু করে। বড় ছেলে থাকে গ্রামে আর ছোট ছেলে থাকে ঢাকায়। তারাও একসময় ছেলেমেয়ের বাবা হয়। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদেরও সংসারের খরচ বাড়তে থাকে। সামী ও সায়েম তাদের চাকরি ও সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবু নাতি-নাতনিদের নিয়ে আলিম সাহেবের দিনগুলো ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুখও তার জীবনে বেশিদিন টেকেনি। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী প্রায় একযুগ আগেই পরপারে স্থায়ী ঠিকানা করে নেয়। স্ত্রী মালিহার মৃত্যুতে বড় একা হয়ে যায় আলিম সাহেব। সবার মাঝে থেকেও সে একাকিত্ব বোধ করে। চোখের আঙিনায় ভেসে আসা ভালোলাগা স্মৃতিগুলো স্মরণ করে সে মনে মনে সুখ অনুভব করে।

অশীতিপর আলিম সাহেব বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। পাঁজরের হাড়গুলোও কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছে। শরীরের ভার বইতে পারছে না। লাঠিতে ভর দিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয়। অসুখ-বিসুখ যেন তার শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে। এ জীবনে আলিম সাহেবের দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। সে এখন শুধুই পরিবারের বোঝা। তাই অসুখ-বিসুখে বিছানায় পড়ে থাকলে তেমন কেউ সেবাযত্ন করে না। তার কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কি না কেউ জানতেও চায় না। পরিবারের সবাই তার কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভুল ধরে। যখন তখন ঝাড়ি মারে। নাতি-নাতনিরাও তাকে সঙ্গ দেয় না। এড়িয়ে চলে। তার রোগগুলো নাকি ছোঁয়াচে। কাছাকাছি থাকলে তার শরীর থেকে অন্যদের শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই সবাই তাকে ভয় পায়। দূরে দূরে থাকে। বউমা প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে। সে অভিযোগ করে বলে, ‘সব কাজ আমাকে করতে হবে কেন? তোমার ছোট ভাইয়ের বউ কী করে? উনি কি লাট সাহেবের বেটি? উনার কাজ ঢাকায় থাকা। কোনোদিন দেখলাম না শ্বশুরকে কিছুদিনের জন্য নিয়ে গেল। আমি এসব বোঝা টানতে পারব না।’ আলিম সাহেব শুনেও না শোনার ভান করে। বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুনের তাপ চোখের সব জলকে শুষে নেয়। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে। তাই আলিম সাহেবের দু’চোখ কেউ অশ্রুসজল হতে দেখে না। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না ভেতরের কষ্টকে।

উঠানের এক প্রান্তে বেশখানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। তার ঠিক পেছনে এক পুকুর রয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া সেই পুকুরে কোনো পানি থাকে না বললেই চলে। সেখানেই এক কামরার একটা টিডশেড তোলা হচ্ছে। সামীর যুক্তি ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের জন্য রুম লাগবে। তাছাড়া কেউ বেড়াতে এলে তাদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। দিন দশেকের মধ্যে ঘর নির্মাণ শেষ হয়। সামী শহর থেকে সস্তায় একটা চৌকি ও একটা টেবিল কিনে আনে। দিনের বেলায় ঘরটা সবাই ব্যবহার করে কিন্তু রাতের বেলায় সেই ঘরে কেউ থাকে না। এভাবেই চলতে থাকে মাস দুয়েক। একদিন বউমা আলিম সাহেবকে বলে, ‘আব্বা, আপনি তো এশার নামাজের পরপর শুয়ে পড়েন। ছেলেমেয়েরা রাত জেগে পড়াশোনা করে। এতে আপনার ঘুমের অসুবিধা হয়। নতুন ঘরটা তো পড়েই থাকে। তাই বলছিলাম আপনি ইচ্ছা করলে ওখানে থাকতে পারেন। আরামে ঘুমাতে পারবেন। কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না।’ আলিম সাহেবের কানের পর্দায় আছড়ে পড়ছিল বউমার কথাগুলো। তাহলে তার অনুমানটাই এতদিনে সত্য হলো। তার জন্যই এই ঘরটা নির্মাণ করা হয়েছে। সবার মাঝে তাকে আর রাখা যাবে না। কিছু্ক্ষণ চুপ থেকে আলিম সাহেব ভাঙা কণ্ঠে বলে, ‘ঠিকই বলেছ। আমার জন্য ঘরটা জুতসই হবে। কাল থেকে আমিই থাকব ওই ঘরে।’ আলিম সাহেবের মতামতটা শোনার পর বউমার চোখে-মুখে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। মনে হচ্ছিল সে যেন যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করে বাড়ি ফিরেছে। পরেরদিন থেকে ওই টিনশেডই হয় আলিম সাহেবের থাকার ব্যবস্থা।

আলিম সাহেব টিনশেডে গরমকালটা কোনোরকমে কাটিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু শীতকালটা আর পার করতে পারছে না। দীর্ঘ রাত তাকে একা একা থাকতে হয়। শীতকালে ঠান্ডাকাশি বেড়ে যায়। টিনশেডে বড্ড শীত করে। লেপকাঁথা মুড়ি দিয়েও শীত ভাঙে না তার। একাকিত্ব বুকের যন্ত্রণা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। স্ত্রীকে তার খুব মনে পড়ে। একসময় এই শীতকালই আসত আলিম সাহেবদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে। আর আজ ঠিক তার উল্টো। একা থাকতে গা ছম ছম করে। রাতের বেলায় সে চোখে ঠিকমতো দেখে না। ঘর থেকে টয়লেটটা খানিকটা দূরে। ক’দিন আগে টয়লেটে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। বড্ড ব্যথা পেয়েছে। সে ব্যথা সবসময় অনুভব করে। একরকম বাধ্য হয়েই ছেলেকে আলিম সাহেব বলে, ‘রাতের বেলা খুব শীত করে। টিনের গা বেয়ে পানি পড়ে। শ্বাসকষ্ট আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া রাতবিরাতে টয়লেটে যাওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর। তাই বলছিলাম কী শীতের ক’টা দিন আমি আগেরমতো তোদের সাথেই থাকি।’ ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আগামীকালই সিলিংয়ের ব্যবস্থা করে দেব। আপনার যখন টয়লেটে যাওয়ার দরকার হবে তখন আমাকে ডাকবেন। আমি নিয়ে যাব। এ নিয়ে একদন চিন্তা করবেন না।’ কংক্রিটের পাকা ঘরে আলিম সাহেবের যে আর ঠাঁই নেই তা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। বাট-বেটা যখন উঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তখন আলিম সাহেবের কানে ভেসে আসে- দু’দিন পরে যে কবরে তার আবার ভয়! সেই নারী কণ্ঠ ছিল তার ছেলের স্ত্রীর। ‘ঠিকই তো আমার আবার ভয় কিসের? দু’দিন পরে তো অন্ধকার কবরে আমাকে একাই থাকতে হবে। আমার তো উচিৎ সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করা।’ মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে আলিম সাহেব নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে টিনশেডের দিকে হাঁটা দেয়।

সপ্তাহ পেরিয়ে যায় তবুও সামী বাবার টিনশেডের ঘরটি সিলিং করে দেয় না। কয়েকদিন ধরে রাতের বেলায় আলিম সাহেবের শ্বাসকষ্টটা ভীষণরকম বেড়ে যায়। তখন তার মনে হয় এই বুঝি তার দম বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেকে কষ্টের কথা বলার সাহস পায় না। দম বন্ধ হলে কারোর কিছু এসে যায় না। বরং তাদের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে যাবে। আলিম সাহেবের শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। সায়েমের কথাও খুব মনে পড়ছে। তাকে দেখার জন্য বাবার মনটা আনচান করছে। এক বছরের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। এনজিও-তে চাকরি করে। কাজের ভীষণ চাপ। তাই ছুটি নিতে পারে না। দুদিন পরে আলিম সাহবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়। সেদিন কোনরকমে এশার নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে। স্ত্রী মালিহার কথা তার খুব মনে পড়ে। তার কাছে যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করতে থাকে। অভিমান করে বলে- আমাকে একা ফেলে তুমি স্বার্থপরের মতো সুখের ঠিকানায় পাড়ি দিয়েছ? ভাবছ সহজে তোমার কাছে যেতে পারব না? সব মিথ্যে মালিহা। সব মিথ্যে। আমি শীঘ্রই তোমার কাছে চলে যাব। আমি যে পারছি না তোমাকে ছেড়ে একা থাকতে। মাঝ রাতে তার শ্বাসকষ্টটা আরও বেড়ে যায়। তার সঙ্গে পেশারটাও বেড়ে যায়। চোখে ঝাপসা দেখে। মনে হয় স্ত্রী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর কখনোই কাউকে কষ্ট দিতে আসবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads