‘তৎকালীন পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে এক জনসভায় অংশ নিতে তখন ভোলায় এসেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় ছাত্রনেতা হিসেবে স্লোগান দিচ্ছিলাম- ‘ইয়াহিয়া না মুজিব।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমার কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘তোদের স্লোগান হচ্ছে না। তোরা বলবি— শিক্ষা শান্তি, প্রগতি প্রগতি’।’ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমন অনুভূতির কথা জানালেন বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া।
উল্লেখ্য, আগামী বছর মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারি তৈরি ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির ৬ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশের খবরের কার্যালয়ে গতকাল এসেছিলেন পত্রিকার সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়ার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে। আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলেন, ভারতের দেরাদুনে অবস্থিত টান্ডুয়া মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) তথা মুজিববাহিনীর অধীনে বরিশালের হিজলা-মুলাদী-মেহেন্দিগঞ্জের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধের প্রেরণার কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করেন। সাংবাদিক নেভিল অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের সেই উক্তিটিকে সত্য বলে তিনি মনে করেন, ‘বন্দি মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে এক লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী।’ তিনি আরো বলেন, ওই সময় যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হতো তবে দেশ কখনোই স্বাধীন হতো না। উদাহরণ দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বলেন, শুধু একজন নেতার অভাবে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমরা কোনো যুদ্ধ ছাড়াই পরাজিত হলাম। যুদ্ধ শুরু না হতেই আত্মসমর্পণ করে বসলাম।
শিক্ষার্থীরা ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়ে জানতে গিয়ে এ দেশের শত্রুপক্ষ, মুজিব হত্যাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের বড় বাধাগুলো কী— এসব বিষয়েও তাদের কৌতূহলোদ্দীপক বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন রাখেন। এসব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বড় বাধাই ছিল জামায়াতিদের দ্বারা গঠিত শান্তি কমিটি এবং আলবদর ও আলশামস বাহিনী। আর এরাই ছিল মূলত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির একমাত্র শত্রু। এদের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া পাকবাহিনীর পক্ষে এ দেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আবার জাতির পিতার যারা হত্যাকারী ছিল তারা কেবল কথিত ‘বিপথগামী সেনা সদস্য’ ছিল না। তারা শুধু উপলক্ষ মাত্র। এই হত্যার পেছনে কাজ করেছে মূলত আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি।
একটি সুসজ্জিত সামরিক শক্তি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে কোন মন্ত্রবলে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং বাঙালিকে বীর জাতি কেন বলা হয়— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা ছিল শোষক, তারা দুর্বল। বিপরীতে আমরা ছিলাম শোষিত অর্থাৎ সাহসী। ফলে আমরা জানতাম আমরা জিতবই এবং সাধারণ মানুষের শতভাগ সাহায্য ছাড়া এ বিজয় কখনোই সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে, এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, যদি ২০০ বছর পেছনেও তাকাই তখন থেকে আজ পর্যন্ত সমসাময়িক বিশ্বে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার সাহসিকতা আর কোনো জাতি দেখাতে পেরেছে কি! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ব্যতীত প্রিয় রাজনৈতিক নেতার নাম বলতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখ করলেও জীবিতদের মধ্যে বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার দিক দিয়ে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাঁর প্রিয় নেতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের প্রকৃত মুক্তির ক্ষেত্রে বলেন, ভৌগোলিকভাবে আমরা স্বাধীন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির স্বাধীনতা এখনো আসেনি। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বাকিটুকু সম্পন্ন করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের কথা বলে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।
সবশেষে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক জনাব আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছু বলার নেই। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর ছেলের উদাহরণ টানেন। ‘আমাদের বাবারা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে যেতে পারেননি’ বিষয়ক এক বিতর্ক প্রতিযোগতায় জনাব ভূঁইয়ার ছেলে বিষয়ের বিপক্ষে বলেছিলেন, জাতির গোটা ইতিহাস একটি রিলে রেসের মতো। এর এক-একটি অংশ এক-এক প্রজন্মের হাতে এসে পৌঁছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ অংশটি বাবারা সম্পন্ন করেছেন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ। এরপর থেকে দায়িত্ব আগামী প্রজন্মের। সুতরাং তোমরাই ঠিক করবে তোমাদের ভবিষ্যৎ।
‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপচারিতার শেষ করেন কাহলীল জিবরানের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে, ‘তোমরা সন্তানদের আদর দিয়ো, বুদ্ধি দিয়ো না।’ অর্থাৎ সন্তানরা স্বপ্ন দেখে তাদের মতো করে। সুতরাং সব বাধা-বিপত্তি দূর করে আগামীর বাংলাদেশ তোমরাই নির্মাণ করবে বলে শিক্ষার্থীদের শুভকামনা জানান বাংলাদেশের খবরের সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া।