গত বছরের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বর্তমানে বিশ্ব আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ চীনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বাতিল থেকে শুরু করে বাণিজ্য সব ধরনের সংশ্লিষ্টতা স্থগিত করে। চীন এ সংকট থেকে উত্তরণে সক্ষম হলেও বিশ্বের ১১৪টি দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারি ঘোষণা করেছে। খবর : বিবিসি ও আলজাজিরার।
এখনো এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। সচেতনতার মাধ্যমে এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বেড়েছে মাস্কের। এর জন্য বিশ্বকে নির্ভর করতে হচ্ছে চীনের ওপর। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীনে অন্যান্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের কারখানাগুলোতে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে মাস্ক।
গত ১০ বছর ধরে চীনের কুয়ানঝু শহরে নিজ বাড়িতে ছোট্ট একটি কারখানায় ডায়াপার এবং শিশুদের অন্যান্য পণ্যসামগ্রী তৈরি করেন লিউ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে তার কারখানার কর্মযজ্ঞে প্রথমবারের মতো পরিবর্তন এসেছে। ব্যবসা বদলে লিউয়ের কারখানায় শুরু হয় মাস্ক উৎপাদন।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ফুজিয়ান প্রদেশে লিউয়ের বাড়ির সে কারখানায় কাজ করেন মাত্র ১০০ জন কর্মী। তার এ কারখানায় দুটি প্রোডাকশন লাইনে দিনে ২ লাখের বেশি মাস্ক উৎপাদিত হচ্ছে। দ্রুতগতিতে উৎপাদিত হতে থাকে লাখ লাখ মাস্ক; যা স্বল্পমূল্যে চীনের বাজারের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছেন লিউ।
তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার নানাভাবে সহায়তা করেছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রপ্তানিতে সরকারও সহায়তা করেছে। চীনে বর্তমানে এ ধরনের হাজার হাজার কোম্পানি তাদের ব্যবসা পরিবর্তন করে প্রথমবারের মতো মাস্ক উৎপাদন শুরু করেছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন করে এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে বিশ্ববাজারের মোট মাস্কের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ করত চীন; যা দিনে প্রায় ২ কোটির মতো। চীনের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থা বলছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে দিনে ১১ কোটি ৬০ লাখ মাস্ক উৎপাদন হয়েছে।
অস্ট্রিয়াভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারিং জায়ান্ট কোম্পানি অ্যান্দ্রিৎজের চীন শাখার প্রেসিডেন্ট থমাস শিমিৎজ বলেন, বেইজিংয়ের এ তাৎপর্যপূর্ণ লাফ যুদ্ধকালীন নীতিমালা বদলের মতো। দেশব্যাপী মাস্ক তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেইজিং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছে, যা দেশটির উৎপাদনশীল ইঞ্জিনকে আরো গতিশীল করেছে।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর চীনের তেল ও গ্যাসের প্রধান কোম্পানি সিনোপেক মাস্কের বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল যেমন পলিপ্রোপিলিন ও পলিভিনিল ক্লোরাইডের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। চলতি সপ্তাহে এ কোম্পানি বেইজিংয়ে নতুন করে দুটি প্রোডাকশন লাইনে মাস্কের ফেব্রিক উৎপাদন শুরু করেছে (যা দিনে চার টন ফেব্রিক উৎপাদনে সক্ষম)। এ ফেব্রিকের মাধ্যমে দিনে অন্তত ৬০ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক এবং এন-৯৫ শ্বাসযন্ত্র তৈরি করা সম্ভব। দেশটির স্থানীয় দৈনিক দ্য সিচুয়ান ডেইলি বলছে, চীনের নতুন স্টিলথ যুদ্ধবিমান জে-২০-এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চেংডু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ তাদের কোম্পানির কিছু অংশে উৎপাদন বদল করেছে। এ কোম্পানির অন্তত ২৫৮ জন ইঞ্জিনিয়ার এখন দ্রুত উৎপাদনশীল মাস্কের নকশা তৈরি করছেন।
চীনে বর্তমানে মুহূর্তে আড়াই হাজারের বেশি কোম্পানি মাস্ক তৈরি করছে। এর মধ্যে আইফোন উৎপাদনকারী ফক্সকন এবং স্মার্টফোন প্রস্তুতকারী শাওমি এবং ওপপো রয়েছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের যুদ্ধকালীন প্রচেষ্টা সর্বশেষ দেখা যায় গত শতাব্দীর মাঝের দিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে। কিন্তু বর্তমানে দ্রুতগতিতে এ ধরনের নীতি বদল চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ করতে পারবে কি না সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুধু মাস্ক নয়, চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের পর করোনা ভয়ংকর হিসেবে দেখা দেওয়া দেশ ইতালির পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। ইতোমধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে দেশটি। সেখানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২৭ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ১৯৬ জন। ইতালিতে এক দিনেই নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৩১৪ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ১০ হাজার ৫৯০ জন। দেশটিতে এখন ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার ৪৬২ জন, চীনের পর যা সর্বোচ্চ।
ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী গিসেপে কন্তে লোকজনকে বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশজুড়েই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশটির ২০টি প্রদেশের সবগুলোতেই জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ইতালির প্রায় ছয় কোটি মানুষ। থমকে গেছে গোটা ইতালি। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় দেশটিতে মেডিকেল কিটের সংকট দেখা দিয়েছে। এজন্য ইউরোপীয় ইউনয়নভুক্ত দেশগুলোর কাছে জরুরিভিত্তিতে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি কেউ। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন।
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জরুরি বার্তা পেয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত সাহায্য পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ইতালিতে ২০ লাখ ফেস মাস্ক, ১০ হাজার লাং ভেন্টিলেটর, ২০ হাজার প্রতিরোধমূলক সুইটস এবং ৫০ হাজার টেস্ট কিটস পাঠানোর ঘোষণা দেন তিনি। একই সঙ্গে চীন করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধে ইতালির চিকিৎসকদের সাহায্যে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি মেডিকেল টিম পাঠানোরও কথাও জানিয়েছেন।