• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

বিবিধ

গৌরবে সংগ্রামে সশস্ত্র বাহিনী

  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০২০

রাজু আলীম

 

 

 

আজ ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশেষ একটি দিন। এই দিনটি সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রযাত্রা এবং বিজয় গৌরবের স্মারক হিসেবে এই দিনটি প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে।

জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুঃসাহসী ভূমিকায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সম্পূর্ণ সামরিক নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরাশক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার আক্রমণ ও প্রতিরোধের সূচনা করে এই দিনে। তাই জাতির এই মহান দিনে জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।

এছাড়া একাত্তরের মহান সংগ্রামে সকল বীর শহীদ বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর আত্মদানকারী প্রতিটি সদস্যের আত্মার শান্তি কামনা করি গভীর ভালোবাসায়। আর সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অফুরন্ত শুভেচ্ছা। এই দেশ আর এই দেশের স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই অর্জনে অগ্রসেনানী হিসেবে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা। এক্ষেত্রে তার নেতৃত্বে স্বাধিকার আদায়ে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়টিও বিশেষভাবে ‍উল্লেখযোগ্য। পুরো জাতিকে স্বাধিকার আদায়ের জন্যে প্রস্তুত করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২৩ বছর। ১৯৪৮-১৯৭১ সাল বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের ইতিহাস সোনার অক্ষরে লেখা আছে।

বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ এবং প্রস্তুত করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পরেই শুরু হয় দুর্বার মুক্তিযুদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে যখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল। তখন ১৯৭১ সালের এই দিনে যুদ্ধকে আরো অপ্রতিরোধ্য করতে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। আর এতেই সমন্বিত আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে শুরু করে পাকবাহিনী। তাই ২১ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিশেষ দিন হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসে। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী শেষ অস্ত্র হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। ওই রাতে আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন- ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং তোমাদের হাতে যা-ই আছে, তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ এই ঘোষণা মুহূর্তেই ইপিআরের ওয়্যারলেস এবং টেলিগ্রামের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সব জায়গায়। এর পরেই এদেশের সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে, তিন বাহিনীর বাঙালি সদস্য, আধা-সামরিক বাহিনী তথা ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারসহ সবাই মিলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলে মুক্তিযুদ্ধ।

এর পরের ইতিহাস মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হওয়ায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ গঠিত হয় এই সরকার। সবার অংশগ্রহণে যুদ্ধকে আরো নিয়মতান্ত্রিক ও কার্যকর করতে সামরিক নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই সরকার এমএজি ওসমানীকে পরে জেনারেল কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেয়। আর কর্নেল (অব.) এমএ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্যে কার্যকর অবকাঠামো গঠন। এই সিদ্ধান্তের ফলে পরবর্তী সময়ে মুক্তিসংগ্রাম আরো ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে কর্নেল ওসমানীর ভূমিকা ছিল বিরল। তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন সংগঠনকে একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসেন এবং একই সঙ্গে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে অপারেশনাল নির্দেশনা প্রণয়ন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের বিরাট বাহিনীর জনবল সংগ্রহ, গোয়েন্দা তথ্য, সাহায্য-সহযোগিতা একই সাথে সাধারণ মানুষের দেখভালের জন্য সাব-সেক্টর বা ক্যাম্প গঠিত হয়। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পথ আরো প্রশস্ত হয়। আর এর পরেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। একেকটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর একেকজন জ্যেষ্ঠ অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্নেল এমএজি ওসমানীর অসাধারণ দক্ষতায় গেরিলা প্রশিক্ষণ, রাজনীতিবিদদের সাথে সংযোগ স্থাপন, অস্ত্রের জোগান ও সরবরাহ ঠিক রাখা, বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় আর বিভিন্ন সেক্টরের সাথে যোগাযোগের কাজ ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে চলে। এর পরে সাধারণ জনগণের মাঝ থেকে বাছাই করে গেরিলা যুদ্ধের জন্যে তৈরি করা হয় যার নাম দেয়া হয় গণবাহিনী। আর এর সাথে গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনী এবং তিনটি ব্রিগেড। নিয়মিত যুদ্ধের জন্যে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর লোকবল নিয়ে ছিল একটি নিয়মিত বাহিনী।

আর তিনটি ফোর্সের মধ্যে ছিল- জেড ফোর্স, এস ফোর্স ও কে ফোর্স। মেজর জিয়াউর রহমানকে প্রথম, তৃতীয় এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত জেড ফোর্সের অধিনায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। মেজর কে এম সফিউল্লাহকে দ্বিতীয় এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত এস ফোর্সের অধিনায়ক নিয়োগ দেয়া হয়। আর চতুর্থ, নবম এবং দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত কে ফোর্সের অধিনায়ক নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। এর পরে পাকিস্তানি দখলদারের বিরুদ্ধে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। যার নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে এই ১১টি সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেড। ৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী গঠনের পূর্বপর্যন্ত এই বাহিনী এগিয়ে নেয় মুক্তিসংগ্রাম।

এর সাথে যোগ হয় আমাদের নৌ ও বিমানবাহিনীর শক্তিও। নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অকেজো এবং বিমানবাহিনী বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলা করে। এসব আক্রমণের সম্মিলিত ফলেশ্রুতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। এই বিজয় ছিল ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং আপামর জনসাধারণ একযোগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সমন্বিত আক্রমণ, তারই ফসল।

এর পরে বঙ্গবন্ধুর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষে মাত্র তিন মাসের মধ্যে ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায় যা ইতিহাসে বিরল। বিশ্বে যুদ্ধের ইতিহাসে মিত্রবাহিনী কখনোই অধিকৃত অঞ্চল থেকে ফেরত আসে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফেরত যায়। এমনকি রাশিয়ান বাহিনীও ফিরে গিয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর চালু করতে এসে তারাও কাজ শেষে ফিরে যায়। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ছাড়াও যুদ্ধ-পরবর্তী দেশ গঠনে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং বিদেশে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে এই সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে বার বার। সোমালিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, লেবানন, হাইতি, সিয়েরা লিয়ন আর লাইবেরিয়াসহ সারা বিশ্বের নানা জায়গায় বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনী ওইসব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং শান্তি রক্ষার পাশাপাশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে সার্বিক সহযোগিতা করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি রক্ষায় কাজ করছে প্রায় চার দশক ধরে যা এই এলাকার এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষায় অনন্য উদাহরণ। এছাড়া সামাজিক উন্নয়ন, রাস্তাঘাট তৈরি এবং দুস্থ মানুষের জন্যে নিরলসভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু অতীতে এই বাহিনীর কিছু লোভী এবং পথভ্রষ্ট সদস্য ক্যু এবং পাল্টা ক্যুর সাথে নিজেদের জড়িয়ে এই বাহিনীর এবং নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, দেশের সার্বিক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা। তাই নতুন ডিজিটাল বাংলাদেশের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল থেকে পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রিয় সশস্ত্র বাহিনী তার যাত্রা মসৃণ রাখবে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে এই আমাদের কামনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads