• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
নাগরিকত্ব ছাড়া ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা

কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোববার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন জাতিংসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গওতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

উখিয়ায় আশ্রয় শিবিরে গুতেরেস-কিম

নাগরিকত্ব ছাড়া ফিরতে নারাজ রোহিঙ্গারা

  • মাহমুদুল হক বাবুল, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৩ জুলাই ২০১৮

নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে ফিরতে নারাজ সেদেশের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। গতকাল সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদলকে এ কথা জানিয়েছেন উখিয়ার ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশে অবস্থান নেওয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার জীবনাচরণ পরিদর্শনে ক্যাম্পে এসে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনতে চান জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট। এ সময় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা জানান, নাগরিকত্ব, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কর্মের নিশ্চয়তাসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তারা ফিরতে চান না। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘোরার ফাঁকেই জাতিসংঘ মহাসচিব টুইট করেন তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে। বলেন, মিয়ানমার থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশের কক্সবাজারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে হত্যা আর ধর্ষণের ২যে বিবরণ আমি শুনেছি সেটা অকল্পনীয়। তারা বিচার চায়, নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চায়।

রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ অবস্থা দেখতে ও বুঝতে এবং বাংলাদেশের প্রতি সমবেদনা জানাতে আন্তোনিও গুতেরেস ও জিম ইয়ং কিম গত শনিবার ঢাকায় আসেন। তারা জানিয়েছেন, এ সঙ্কট এবং রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব। রোহিঙ্গাদের পাশে থাকায় বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, এই সঙ্কট উত্তরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো অনেক কাজ বাকি, আর সেজন্যই তিনি ও জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে এসেছেন।

গতকাল বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকা থেকে রওনা করে সকাল পৌনে ৯টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করেন গুতেরেস ও কিম। সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের প্রেসিডেন্ট পিটার মুরার। বিমানবন্দর থেকে তারা যান কক্সবাজার সৈকতের কলাতলীতে সাইমন বিচ রিসোর্টে। সেখানে গুতেরেস ও কিমকে রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং সমস্যা নিয়ে অবহিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর তারা যান উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে, যা ঘুমধুমের টিভি রিলে কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। মূলত নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ওই ক্যাম্পে রাখা হয়। সেখানে নিবন্ধন শেষে পাঠানো হয় অন্যান্য ক্যাম্পে। জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ২০ জন নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী ও ২০ জন পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন ট্রানজিট ক্যাম্পে। তাদের একজন শফিকা বেগম (২৫) জানান, তারা এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সসম্মানে মিয়ানমারে ফেরার ব্যবস্থা করছেন এবং প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা করবেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদলটি ট্রানজিট ক্যাম্পসহ তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র এবং দুটি নারীবান্ধব কেন্দ্র ও হাসপাতাল ঘুরে দেখে।

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে গত আগস্ট মাসের পর থেকে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে এর আগে জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে জাতিগত নিধন অভিযান হিসেবে। আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর আগে জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা শিবির সফর করলেও মহাসচিব এই প্রথম তাদের দেখতে গেলেন। বিকাল ৪টার দিকে কক্সবাজার রওনা হওয়ার আগে প্রেস ব্রিফিং করেন জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট।

গুতেরেস জানান, রোহিঙ্গাদের যে দুঃখকষ্ট তিনি দেখেছেন তাতে তার হূদয় ভেঙে গেছে। বলেন, ছোট ছোট রোহিঙ্গা শিশুদের দেখে আমার নাতি-নাতনিদের কথা মনে পড়ে গেছে। তাদের অবস্থাও যদি এমন হতো তাহলে কীরকম হতো। জাতিসংঘ মহাসচিব জানান, রোহিঙ্গারা যাতে দেশে ফিরে যেতে পারে সেজন্য তারা কাজ করছেন। তবে তিনি বলেন, তাদের ফিরে যাওয়া শুধু সেখানে অবকাঠামো তৈরির বিষয় নয়। তারা যাতে সম্মানের সঙ্গে ফিরে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারে পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে উল্লেখ করে গুতেরেস বলেন, এই অবস্থা এভাবে চলতে পারে না। এর একটা সমাধান করতে হবে। আলজাজিরার এক সাংবাদিকের প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের নাগরিক, তাই এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে মিয়ানমারকে তাদের ফেরত নিতে হবে, যেহেতু রোহিঙ্গারা স্বদেশে নিরাপদে ফিরতে চায়। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা নিঃস্ব। তাদেরকে বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা যতদিন এখানে থাকবে ততদিন বিশ্বব্যাংক সাহায্য-সহযোগিতা করবে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাশে থেকে রোহিঙ্গারা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে সেজন্য কাজ করছে।

বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে ১১ লাখের বেশি। তাদের মধ্যে উখিয়ায় আছে ৭ লাখ। যাদের মধ্যে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছে প্রায় ২ লাখ। গত মাসের ভারী বর্ষণে সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা।

গুতেরেস এর আগে ইউএনএইচসিআরের শীর্ষপদে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনে এসেছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশে এটাই তার প্রথম সফর। আর বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম দুই বছর আগেই একবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads