• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
খাদ্যগুদাম নির্মাণে বাড়তি ব্যয় ২ হাজার কোটি টাকা

খাদ্যগুদাম

সংরক্ষিত ছবি

জাতীয়

খাদ্যগুদাম নির্মাণে বাড়তি ব্যয় ২ হাজার কোটি টাকা

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ৩১ জুলাই ২০১৮

সরকারি পর্যায়ে দেশে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ক্ষমতা ১৮ লাখ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন কমলে সংরক্ষণ করা খাবারে চাহিদা পূরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সারা দেশে আটটি স্টিলের তৈরি আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। খাদ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য ধরা হয় ৫ লাখ ৪৩ হাজার টন।

১ হাজার ৯১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার প্রকল্পে সাড়ে চার বছরে ব্যয় হয়েছে ২১৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আইএমইডি প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অযাচিত ধীরগতির কারণে প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা কঠিন হবে। এতে সরকারের তহবিল থেকে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাবে বলেও ধারণা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

আইএমইডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মূল কাজ তথা আট সাইলো নির্মাণে ১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এ কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে একটি প্যাকেজের বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

 দুটি প্যাকেজের দরপত্রে চূড়ান্ত অগ্রগতি হয়েছে। আটটি সাইলোর ভূমি উন্নয়ন, সাইট অফিস নির্মাণ ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণে অবশ্য ৫১ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সাইট অফিস নির্মাণে ল্যাবরেটরি টেস্ট ছাড়াই নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি, উদ্বৃত্ত ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় আটটি সাইলো নির্মাণে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৪ সালের ১১ মার্চ। ১ হাজার ৯১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরে চলমান প্রকল্পে ১ হাজার ৮৭৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা দেবে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এতে সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় হবে মাত্র ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ৪০ কোটি টাকা দেবে প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা। ২০২০ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। কাজের তদারকির অংশ হিসেবে সম্প্রতি প্রকল্পটির নিবিড় পরিদর্শন পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিলম্বের কারণে এর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে না। ফলে প্রকল্পের ব্যয় অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ, দাতা সংস্থার শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানের ক্রয় প্যানেল নিয়োগ, প্রস্তাবিত সাইলোর চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, ঠিকাদার নির্বাচন, বিভিন্ন প্যাকেজে দাতা সংস্থার অনাপত্তি গ্রহণ, সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি প্রতিবেদন প্রণয়নসহ কাজ শুরুর আগে প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে বাড়তি সময় লেগেছে। বরিশাল সাইলো সাইটের ভূমি উন্নয়নে জটিলতা, নারায়ণগঞ্জ সাইটের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ, চট্টগ্রাম সাইটের অবহূত ভবন ও স্ক্র্যাপ মালামাল নিষ্পত্তিকরণ, খুলনা সাইটের জরাজীর্ণ ভবন অপসারণ, ময়মনসিংহ সাইটের পুরনো খাদ্যগুদাম অপসারণ কাজে বাড়তি সময় লেগেছে।

প্রকল্পের আওতায় প্রায় পাঁচ লাখ কৃষককে বাড়িতে ব্যবহারের জন্য ছোট আকারের সাইলো দেওয়া হবে। তাদের কেউ এখনো সাইলো না পেলেও প্রায় শতভাগ উপকারভোগী জানেন যে, তারা নিবন্ধিত হয়েছেন। ৭৭৪ উত্তরদাতার সাড়ে ৫১ শতাংশ মনে করেন বন্যা বা দুর্যোগপরবর্তী সময়ে খাদ্যের ঘাটতি দূর করতে এসব সাইলো ভূমিকা রাখবে। প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ সুবিধাভোগী আধা একরের কম জমির মালিক। সর্বশেষ দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ২৮ দশমিক ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা। তাদের ফসলের গড় ক্ষতির পরিমাণ ১১৩ কেজির বেশি। মোট উত্তরদাতার হিসাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে গড়ে ৩২ কেজির বেশি।

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম অর্থবছরে (২০১৩-১৪) ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দের চাহিদা থাকলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় কোনো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। পরের বছর ডিপিপিতে ৭৮৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ওই অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয় মাত্র ১২ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭৯৮ কোটি ১০ লাখ টাকা চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ ছিল ৩০০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বছর শেষে ব্যয় হয় মাত্র ৬৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এভাবেই প্রতিবছর প্রকল্পটির কাজ পিছিয়ে গেছে।

প্রকল্পটির আওতায় ১৯ জেলায় পাঁচ লাখ পরিবারে স্টিলের তৈরি ছোট আকারের সাইলো সরবরাহের লক্ষ্য আছে। এ খাতে মোট বরাদ্দ আছে ৮৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত কোনো পরিবারে সাইলো বিতরণ করা হয়নি। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের শেষদিকে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ সাইলো নির্মাণ হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি।

প্রকল্পের কাজে বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের মার্চে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পেলেও এর প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬ আগস্ট। পিডি নিয়োগ দিতেই বাড়তি লেগেছে পাঁচ মাস। বিদেশি ক্রয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে বাড়তি লেগেছে এক বছর। তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। হলি আর্টিজান দুর্ঘটনার কারণে সাইলোর কাজ পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত বিদেশি পরামর্শকরা ঢাকায় আসতে অনীহা প্রকাশ করায় বাড়তি সময় লেগেছে। তা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিটি প্যাকেজের অনাপত্তি দিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে স্টিল সাইলো নির্মাণে যে ব্যয় উঠে এসেছিল প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এর চেয়ে কম। সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ, ভূমি উন্নয়ন, মূল অবকাঠামো তথা স্টিল সাইলো নির্মাণে খরচের প্রাক্কলন ও টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এতে আরো বলা হয়েছে, প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে খাদ্য বিভাগের যথেষ্ট জনবল নেই। প্রকল্পের কাজ তদারকিতে মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ নিয়েও সংশয় রয়েছে আইএমইডির। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, খাদ্য ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে প্রতিবছর সরকারি খাদ্য ক্রয়ের লক্ষ্য পূরণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে স্টিল সাইলোর জন্য অতিরিক্ত ৫ লাখ ৪৩ হাজার টন খাদ্য সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়বে।

এ অবস্থায় দ্রুত কাজ শেষ করতে প্রকল্পটি সংশোধনের সুপারিশ করেছে আইএমইডি। প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক থেকেই সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালানোরও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads