মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত অভিযানে কোটা আন্দোলনের সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমা ওরফে নীলাকে সিরাজগঞ্জের খিদ্রচাপড়ীচর গ্রামের দাদার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। একই সঙ্গে ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়ায় রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে আহমাদ হোসাইন ও নাজমুস সাকিব নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইম ইউনিট। আর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তাসনীম আফরোজ ইমিকে আটক করে তিন ঘণ্টা পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
শুধু এই ক’জনই নন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা ফেসবুকে বিভিন্ন নেতিবাচক ও উত্তেজিত স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। এদের সংখ্যা কয়েকশ হবে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে শিক্ষার্থী মহলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীসহ ৯৭ জন এখন বিচারের অপেক্ষায় জেলে বন্দি রয়েছেন। এর আগে ফেসবুক লাইভে ছাত্র মৃত্যুর গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন অভিনেত্রী ও মডেল কাজী নওশাবা আহমেদ। এ পরিস্থিতিতে ইউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল বুধবার বিবৃতি দিয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় গতকাল বুধবার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, কোটা কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছেন তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। এতে যাদের ঠিকঠাক সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে কেবল তাদেরই ধরা হচ্ছে। ফেসবুকে ঠিক কতজন গুজব ছড়িয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান পুলিশ বের করতে পেরেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নথি না দেখে সংখ্যাটা বলতে পারব না। তবে সাইবার ক্রাইম যাদেরকে শনাক্ত করতে পেরেছে তাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে।
কোটা আন্দোলনের নেত্রী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী গ্রেফতার : কোটা আন্দোলনের সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমা ওরফে নীলাকে গ্রেফতারের তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক।
লুমা ইডেন মহিলা কলেজের ২০১৪-১৫ সেশনের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। গত ৫ আগস্ট ঢাকার রমনা থানায় দায়ের হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে ধর্ষণের গুজব ছড়ানোর কারণে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সেদিন শিক্ষার্থীদের রাস্তায় অবস্থানের সময় হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এসে বেশ কয়েকজন বলতে থাকে, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ধর্ষণ, হত্যা করা হচ্ছে। এ সময় বোরকা পরা এক তরুণী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘জিগাতলাতে তাদের পার্টি সেন্টারে অনেক অনেক মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে। প্লিজ কিছু করেন।’ মেয়েটির মুখ এমনিতেই ঢাকা ছিল। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের সময় তার সেই মুখেও ক্যামেরা ধরা হয়নি। চিৎকার করে ওই তরুণী যা যা বলতে থাকেন তার সব বুঝা যায়নি। যতটুকু বুঝা যায় সেটুকু হলো, ‘ওরা গুলি করতেছে, ওরা কি ছাত্র? ওরা কি আদৌ কোনো ছাত্র?’ এটি যখন রেকর্ড করা হচ্ছিল, তখন দুই তরুণকে পেছন থেকে দেখা যায়। তবে তারা ক্যামেরার সামনে আসেননি। মেয়েটি বলতে থাকেন, ‘জিগাতলা পার্টি সেন্টারে প্রতিটা ছাত্ররে ঢুকাইয়া ঢুকাইয়া গুলি করতাছে, প্লিজ।’ বোরকা পরা মেয়েটির মুখ ভালোভাবে দেখানো হয়নি ভিডিওতে। তবে এটি লুনা বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারণা করা হচ্ছিল। এরপরই বুধবার ভোরে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি তদন্ত দল ও বেলকুচি থানা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলের চাপড়িরচর গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করে। লুমাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে।
জানতে চাইলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউল্লাহ বলেন, লুমার নামে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গুজব ছড়ানোর যে মামলা করা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভিডিওর মেয়েটি লুমা নয়। সে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে ঢাকায় নেই। সে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল না।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর দায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো দু’জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইম ইউনিট। জানতে চাইলে গতকাল বুধবার দুপুরে সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইম ইউনিটের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শারমিন জাহান বলেন, কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতার হওয়া দু’জনই ফেসবুকে বিভিন্ন উসকানিমূলক পোস্ট ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ও ৬৬ ধারায় মামলা করা হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতা-উসকানির ঘটনায় ৫১ মামলা : শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানির প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় মোট ৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি : বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ঘিরে গণগ্রেফতার চলছে বলে মন্তব্য করেছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সরকার ভিন্নমত দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে সংস্থাটি নির্বিচারে গ্রেফতার বন্ধ, ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে আটককৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি ও শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংস হামলার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল বুধবার নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে সংগঠনটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করার জন্য একটি অস্পষ্ট আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট অনুসরণ করে এরই মধ্যে কয়েক ডজন মানুষকে আটক করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ২৯ জুলাই দ্রুতগতির একটি বাসের ধাক্কায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদী তরুণরা নিরাপদ সড়ক, প্রশাসনের জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার দাবি জানায়। পরে তারা নিরাপত্তা বাহিনীর টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেটের শিকার হন। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাদের ওপর সহিংসতা চালায়। পরে এই সহিংসতার বিষয়ে যেকোনো ধরনের সমালোচনা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয় প্রশাসন। বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থাকেন, শহরের এমন একটি অঞ্চলে অভিযান চালায় ঢাকার পুলিশ। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পুলিশ সব বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা খুঁজতে তারা দ্বারে দ্বারে গিয়ে মোবাইল ফোন চেক করেছে। প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও মানবাধিকার কর্মী শহিদুল আলমকে ৯ দিন ধরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদের জামিন নামঞ্জুর করে কাস্টডিতে রাখা হয়েছে। প্রায় সব গ্রেফতারই করা হয়েছে ৫৭ ধারায় আইসিটি আইনে।