• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জিআই পণ্যের নিবন্ধন পাচ্ছে ‘ক্ষীরশাপাতি’

তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘ক্ষীরশাপাতি’ আম

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

জিআই পণ্যের নিবন্ধন পাচ্ছে ‘ক্ষীরশাপাতি’

  • কাওসার আলম
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৮

জামদানি ও ইলিশের পর বাংলাদেশের তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘ক্ষীরশাপাতি’ আম। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি ‘হিমসাগর’ নামে অধিক পরিচিত। নিবন্ধন পাওয়ার মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। এতে এ জাতের আমের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

উল্লেখ্য, ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হচ্ছে এমন সব কৃষিজাত বা প্রকৃতিজাত বা প্রস্তুতকৃত পণ্য, যার সঙ্গে ওইসব পণ্যের বিশেষ গুণাগুণ, সুনাম বা অন্যান্য বৈশিষ্টগুলো অবশ্যই তার ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থলের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে জামদানি। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) জিআই পণ্য হিসেবে ‘জামদানি’ নিবন্ধনের সনদ দেওয়া হয়। এর পর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জাতীয় মাছ ইলিশকে। ‘বাংলাদেশের ইলিশ’ হিসেবে জিআই পণ্যটির নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয় মৎস্য অধিদফতরকে। তৃতীয় পণ্য হিসেবে নিবন্ধন সনদ পেতে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘ক্ষীরশাপাতি’ আম। বাংলাদেশে জিআই পণ্যের নিবন্ধন সনদ দিয়ে থাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস অধিদফতর (ডিপিডিটি)।   

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্ষীরশাপাতি আম’কে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ডিপিডিটিতে আবেদন করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হামিম রেজা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এ আবেদন জমা দেন। আবেদনটি যাচাই-বাছাই শেষে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন), ২০১৩ অনুযায়ী এটি ‘দ্য জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) জার্নালে’ প্রকাশে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিজি প্রেসে পাঠায় ডিপিডিটি। গত ১০ আগস্ট এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পরে তা ডিপিডিটির ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়। গেজেট প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আপত্তি জানানোর নিয়ম রয়েছে। গত ১০ আগস্ট দুই মাস সময় পার হয়েছে এবং এ সময়ের মধ্যে ডিপিডিটিতে কোনো ধরনের আপত্তি জমা পড়েনি। ফলে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেতে আইনি বাধা দূর হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিপিডিটির রেজিস্ট্রার সানোয়ার হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আমের গেজেট প্রকাশের পর দুই মাসের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আপত্তি জমা পড়েনি। সুতরাং আইন অনুযায়ী নিবন্ধন সনদ প্রদান করবে ডিপিডিটি। কিছু দাফতরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হবে বলেও জানান তিনি।

ডিপিডিটির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনে কোনো ধরনের আপত্তি জমা না পড়ার বিষয়টি আবেদনকারীকে অবহিত করা হবে। এর পর নিবন্ধনের নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ডিপিডিটিতে আবেদন করতে হবে। এর পর জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রদান করবে ডিপিডিটি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অনুকূলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘ক্ষীরশাপাতি’ আমের নিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হবে। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নিবন্ধন সনদ দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে, নিবন্ধন সনদ পাওয়ার পর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এ জাতের আম উৎপাদন করে তাদের তালিকা তৈরি করবে। উৎপাদক হিসেবে তাদেরও নিবন্ধন সনদ নিতে হবে। এ জন্য কৃষি ইনস্টিটিউট তাদের প্রস্তুতকৃত তালিকা পাঠানোর পর যাচাই-বাছাই করে গেজেট আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেবে ডিপিডিটি। গেজেট প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে কোনো আপত্তি না পাওয়া গেলে তারাই (তালিকায় প্রকাশিত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি) এ জাতের আম উৎপাদনে নিবন্ধন সনদ পাবে। প্রথমবার ৫ বছরের জন্য সনদ দেওয়া হবে এবং পরবর্তীতে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর সনদ নবায়ন করতে হবে। এ জন্য নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে।

নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কোনো অনুমোদিত ব্যবহারকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যটির নবায়ন না করে উৎপাদন, গুদামজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, পরিবহন অথবা বিক্রয় করা হয় তাহলে সেটি আইন অনুযায়ী অপরাধ কার্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং মামলা দায়ের করা যাবে। আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে ন্যূনতম ৬ মাস ও সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ডে এবং সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এদিকে প্রকাশিত জার্নালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আমের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে, এ জেলার কৃষি পরিবেশিক অঞ্চল ১১-এর উচ্চ গঙ্গা নদী প্লাবন ভূমির অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালোমানের ক্ষীরশাপাতি আম উৎপাদনকারী এলাকার জন্য মাটির পিএইচ ৬.৫ থেকে ৭.৫ প্রয়োজন, যা ওই এলাকায় রয়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের আবহাওয়া আমের গুণগত মানকে প্রভাবিত করে। সাধারণত দেখা যায়, আমগাছে মুকুল আসার সময় আবহাওয়া শুষ্ক ও ঠাণ্ডা এবং আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময়ে শুষ্ক ও গরম (২৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) থাকে। ফলে আমের ফলন ও মান উভয়ই ভালো হয়। আমের মুকুল আসার সময় বা মুকুল বের হওয়ার পর বৃষ্টিপাত হলে বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে এবং আমের বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার সময় বেশি বৃষ্টি হলে আমের গুণগত মান খারাপ হয়।

দেশের অন্য জেলায় আম উৎপাদন হলেও মাটি ও আবহাওয়ার পার্থক্যের কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো ক্ষীরশাপাতি আম উৎপাদন সম্ভব নয়। আমের বর্ণনায় বলা হয়েছে, এটি আমের উৎকৃষ্ট জাতগুলোর মধ্যে একটি মধ্যম মৌসুমি ও খুবই জনপ্রিয় বাণিজ্যিক জাত। ফল মাঝারি আকারের এবং অনেকটা ডিম্বাকৃতির। এ ফল গড়ে লম্বায় ৮.৬ সে.মি, পাশে ৭.৫ সে.মি, উচ্চতায় ৬ সেমি এবং ওজন গড়ে ২৬৩.৯ গ্রাম। পাকা ফলের ত্বকের রঙ সামান্য হলদে এবং শাঁসের রঙ হলুদাভ। শাঁস আঁশবিহীন, রসালো, গন্ধ আকর্ষণীয় ও বেশ মিষ্টি। জ্যৈষ্ঠ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আম পাকা শুরু হয়। ফল পাড়ার পর পাকতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। ফলন খুবই ভালো তবে অনিয়মিত। ফল পরিপক্ব হতে (ফুল আসা থেকে) ৪ মাস সময় লাগে। ১৯৫৫ সাল থেকে এ আমটি ব্যবহারের ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে বলে জার্নালে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান বিশ্বের বস্তুগত সম্পদ সীমিত কিন্তু মেধা সম্পদ অফুরান। ভৌগোলিক পণ্য নির্দেশক পণ্য মেধা সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য শনাক্তকরণ, নিবন্ধন ও সুরক্ষার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচুর সুযোগ রয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা লাভের পাশাপাশি শক্তিশালী ব্র্যান্ডের মর্যাদা লাভ, বিপণনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করা, ভোক্তা সাধারণের অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সমুন্নত রাখবে। নতুন বাজার সৃষ্টি, রফতানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও জিআই পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জরিপে দেখা গেছে, নিবন্ধিত জিআই পণ্যগুলো ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমজাতীয় অনিবন্ধিত পণ্যের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি মূল্য দিতে সম্মত থাকেন ক্রেতারা।

তবে বাংলাদেশে জিআই পণ্য নিবন্ধনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমানে ২৯টি পণ্যের জন্য ৩১টি আবেদন জমা পড়েছে ডিপিডিটিতে। এসব আবেদনের ৮০ শতাংশই বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে করা হয়েছে। তবে আবেদনগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় পণ্য নিবন্ধনে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads