• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ভরা মৌসুমে ইলিশের খরা

ভরা মৌসুমেও জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না ইলিশ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

ভরা মৌসুমে ইলিশের খরা

  • নাজমুল হুসাইন
  • প্রকাশিত ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সরকারি মৎস্যপঞ্জি অনুযায়ী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। বছরের মোট আহরণের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ইলিশ ধরা পড়ে এ সময়ে। ঘাট এলাকা থাকে কেনা বেচায় সরগরম। ইলিশ কিনতে হিড়িক পড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারগুলোতে। কিন্তু এ বছর সেপ্টেম্বরে এসেও ইলিশের দেখা মিলছে না। আগে এই মৌসুমে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়লেও এখন নদী থেকে জেলেরা ফিরছেন খালি হাতে। চাঞ্চল্য নেই ইলিশ আহরণকারী জেলেপাড়াগুলোতেও। ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়ের মোকামগুলোও অনেকটা সুনসান। অথচ গত দুই বছরে এ সময়ে সারা দেশে ইলিশের প্রাচুর্যে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়েছিল।

তবে ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেরিতে হলেও আগের সেই প্রাচুর্য ফিরে আসবে এ বছরও। পাঁচ কারণে এ বছর এ মাছ দেশের নদ-নদীতে দেরিতে আসছে বলে জানিয়েছেন তারা।

ইলিশের মোকামখ্যাত বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসির ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট এম রুহুল আমিন জানান, ভাদ্রের ভরা মৌসুমে এসেও বঙ্গোপসাগর ও নদীগুলোতে খুব একটা দেখা মিলছে না রুপালি ইলিশের। মাছ না পাওয়ায় আর্থিক সঙ্কটে রয়েছেন বরগুনার প্রায় এক লাখ জেলে। সেখানে গত এক সপ্তাহে ১৭৩ টন ইলিশ বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় কয়েকগুণ কম।

পাথরঘাটার পাইকারি বাজারের কয়েকজন মাছ বিক্রেতা জানান, মাছের আমদানি কম। জাটকা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা দরে। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা। এক কেজি সাইজের ইলিশ কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টাকা দর চলছে। তার ওপরে উঠলেই দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত দু’বছর থেকে দেশে ও উজানে বেশ বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সেসময় উজান থেকে প্রচুর পানি নামার ফলে ইলিশ সমুদ্র থেকে ওপরের দিকে উঠে আসে আগেভাগে। তবে এ বছর সমুদ্রে ইলিশের কোনো ঘাটতি না থাকলেও প্রকৃতি আগের মতো অনুকূল ছিল না। প্রজনন মৌসুমে বৃষ্টিও ছিল অপর্যাপ্ত। এ বছর সেটা হয়নি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। নদ-নদীতে নামেনি ঢল। আর সমুদ্রের পরিস্থিতি ছিল বেশি উত্তাল। এর সঙ্গে প্রজনন মৌসুমের শুরুর দিকে বেশিরভাগ সময় গড় তাপমাত্র ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকায় মাছ গভীর সমুদ্র থেকে সময়মতো নদীমুখী হয়নি। এ ছাড়া ক্রমান্বয়ে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া ইলিশের সংখ্যা না বাড়ার একটি কারণ।

দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ নিয়ে কাজ করছেন এ বি এম জাহিদ হাবিব। দেশের ইলিশ সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প ‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান এবং গবেষণা’ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের খবরকে জাহিদ হাবিব বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে ইলিশের প্রজনন বিলম্বিত হয়েছে। এরপর অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, নদীতে ঢল না থাকা, সমুদ্র বেশি উত্তাল থাকা ও নদীর গভীরতা কমে যাওয়া— সবমিলিয়ে পাঁচ কারণে এবার এখনো কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশের দেখা মেলেনি।

তবে তিনি বলেন, আগের বছরগুলো থেকে এ বছরও সাগরে ইলিশের কোনো কমতি নেই। সাগরে ইলিশ প্রজননের সময় প্রথমধাপে তীরবর্তী এলাকায় আধা-লবণাক্ত পানিতে দেড়-দুই মাস থাকে। গত দুই বছর ওই সময়টা ছিল জুন-জুলাইয়ে। এ বছর সেটা আগস্টের শেষ এবং সেপ্টেম্বরের শুরুতে এসে ঘটছে। ফলে এখন সমুদ্রে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে, চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, এ বছরের প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর হবে ইলিশের ভরা মৌসুম। কারণ গত আগস্টে ২৬ তারিখে একটি পূর্ণিমা গেছে। আর চলতি সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে একটি করে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা পড়েছে। সেসময় ইলিশের ঢল নামবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আগামী ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোতে এ মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।

এ গবেষক বলেন, ‘কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না, এ বছর ইলিশের উৎপাদন আগের থেকে কমবে। তবে পুরোটা প্রাকৃতিক বিষয় হওয়ায় নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়।’

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে। সেপ্টেম্বরের শেষভাগে জিএসআই (ড়েহধফড় ঝড়সধঃরপ ওহফবী— মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার) ১০-১১ থেকে বেড়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নভেম্বরে এসে তা আবার হঠাৎ কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদীর স্রোত, পানির তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেও ইলিশের প্রজননক্ষণ পরিবর্তিত হয়। এ বছরও এমনটা হচ্ছে বলে ধারণা তাদের।

বাংলাদেশের জাতীয় এ মাছের উৎপাদনে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে ২০০৭ সাল থেকে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ ৯০ হাজার টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৯৬ হাজার টনে। অর্থাৎ বিগত আট বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। মা মাছ সংরক্ষণসহ জাটকা শিকার বন্ধ হওয়ার কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে দাবি সরকার সংশ্লিষ্টদের।

কয়েক দশক আগে মাত্র চার জেলায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল ইলিশের বাণিজ্যিক আহরণ। গত কয়েক বছরে ইলিশের বিচরণ বেড়ে ২৮টি জেলায় পৌঁছায়। আর এ বছর তা আরো বেড়ে ৩৭ জেলায় বিস্তৃত হবে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। এ কারণে এ বছর ৩৭ জেলার মোট ১৬১টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণ ও জাটকা সংরক্ষণের প্রকল্প চালানো প্রস্তাব করা হয়েছে।

আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান, তিন মণ ধান বিক্রি করেও বরগুনায় মিলছে না এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ। ইলিশের মোকামখ্যাত বরগুনার পাথরঘাটায় চলছে এ অবস্থা। সেখানে মোটা ধানের মণ এখন ৪৮০ টাকা। অথচ ওই এলাকার বাজারে বর্তমানে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ধানের এ নিম্নমুখী বাজারমূল্যে এখন কৃষকের মাথায় হাত।

এ প্রসঙ্গে কৃষি কর্মকর্তা এস এম বদরুল আলম জানান, ধানের দাম কম এটা সত্য। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads