জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭ অভীষ্ট অর্জনে ২৩২ সূচকের মধ্যে বাংলাদেশে তথ্য রয়েছে মাত্র ৭০টির। এসডিজি বাস্তবায়নের দুই বছরের অগ্রগতি পর্যালোচনায় ব্যবহার করা হয়েছে ৬৩টি সূচক। এর মধ্যে ৩৩ সূচকের অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে রয়েছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে এসডিজি অর্জনে অর্ধেক সূচকের অগ্রগতি ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে বলে দাবি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। অবশ্য এসডিজি বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি পর্যালোচনায় তথ্যের ঘাটতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। দুই বছরের এসডিজি বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
গতকাল রোববার রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০১৮ প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মিয়া সিপ্পো, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করার পাশাপাশি প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমএ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসডিজি বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারতের তুলনায় ভালো করেছে। তবে বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তথ্যের ঘাটতি। কিছু ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই তথ্য নেই। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ও অন্যান্য তথ্য প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সংস্কার আনা হবে।
মন্ত্রী আরো বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নতিও অভাবনীয়। এসডিজি অর্জনে বিদেশি সহায়তা ও বিনিয়োগের অর্থ কার্যকর ব্যবহারের চেষ্টা করা হবে। এসডিজি অর্জনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। সরকারি খাত, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও সুশীল সমাজসহ সবাইকে নিয়ে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন মন্ত্রী।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দারিদ্র্য নিরসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে ব্যয়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমানো, নবজাতকের মৃত্যুর হার, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে তামাক পণ্য সেবন কমিয়ে আনা, স্বাস্থ্য গবেষণা ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় বিদেশি সহায়তা বরাদ্দ, বিনিময় মূল্য ছাড়া গৃহস্থালি কাজ কমিয়ে আনা, জাতীয় সংসদে মহিলাদের অংশগ্রহণ, বিদ্যুৎ ব্যবহার, কর্মে নিয়োজিত মানুষের মাথাপিছু উৎপাদন, কৃষির বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান কমিয়ে আনা, উৎপাদনশীল খাতে মূল্য সংযোজন বাড়ানো, মোবাইল নেটওয়ার্ক কভারেজ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা, মানব পাচার প্রতিরোধ, রফতানির আয়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ কমিয়ে আনা এবং ব্যক্তি পর্যায় ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির সূচকে বেশ উন্নতি হয়েছে।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি থাকলেও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতের অনেক সূচকেও অগ্রগতি হতাশাজনক। পরিষ্কার পানি পান ও ব্যবহার, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, বেকারত্ব হার কমানো, তরুণদের কাজে লাগানো, উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান, জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের সূচকে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে করণীয় নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে শোভন কাজের হার ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে এসডিজিতে। ২০১৭ সাল শেষে এর হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে। শিক্ষা, কর্ম বা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের বাইরে থাকা ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর হার ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সরাসরি বিদেশ বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এফডিআই আসছে না। এফডিআই পোশাক খাত, টেলিকম এবং বিদ্যুৎ খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অনেক খাতেই এই বিনিয়োগ আসার সুযোগ রয়েছে।
প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে ২০২০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ১৮ দশমিক ৯ জনে উন্নীত করার লক্ষ্য থাকলেও ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৪ জন। বর্তমানে প্রতি হাজারে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৮ দশমিক ৩ জনে। এ সূচকে লক্ষ্যের চাইতে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের নিরাপদ পানি ব্যবহারের লক্ষ্য থাকলেও অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ। ২০১৫ সাল থেকে একই অবস্থানে রয়েছে নিরাপদ পানি ব্যবহারের হার। ১০ শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিশ্চিতের লক্ষ্য থাকলেও এর হার বর্তমানে মাত্র ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
অন্যদিকে দারিদ্র্য নিরসনে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। যেটি ২০২০ সালের মধ্যে লক্ষ্য রয়েছে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। অতি দারিদ্র্য হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। লক্ষ্য রয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার।
ড. মসিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের হার প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। পাইপলাইনে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে। এসডিজি অর্জনে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর হার বাড়াতে হবে। শিল্প খাতে বেশ কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও দ্রুত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আরো পদক্ষেপ প্রয়োজন।
মিয়া সিপ্পো বলেন, দারিদ্র বিমোচনে সাফল্য এলেও কর্মসংস্থান বাড়ানো বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ। জনশক্তির দক্ষতারও অভাব রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি বরাদ্দ প্রত্যাশার চেয়ে কম। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কাজে লাগাতে হলে এসব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আয় বৈষম্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম। এক্ষেত্রে নীতি সহায়তার অভাব রয়েছে। নিচের দিকে লিঙ্গ বৈষম্য কমে এলেও উচ্চ শিক্ষায় তা প্রকট। বাল্যবিয়ের হার বাড়ছে। দ্রুত নগরায়নের কারণে পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে এসব ঝুঁকি মোকাবেলার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি রোধ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও দাবি করেন ইউএনডিপির প্রতিনিধি। তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শক্তিশালী করতে হবে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। তাছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন, গুম, সাংবাদিকদের স্বাধীনতার মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, পরিবেশের ক্ষতি না করে শিল্পায়ন, কৃষি জমির পরিমাণ ধরে রাখার উপায় বের করতে হবে। তরুণদের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনমিতি সুবিধা কাজে লাগাতে কর্মহীনতা কমাতে হবে। পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে স্বল্প খরচে উদ্ভাবনী বিষয়গুলো জাগ্রত করতে হবে।
নজিবুর রহমান বলেন, এসডিজি বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এটি অর্জনে সব ধরনের নীতি সহায়তা দিচ্ছেন। এজন্য ব্যাপক কার্যক্রম ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু খাতে উন্নতি হলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়নি। সকল খাতে অর্জন সমান হয়নি। নারী ও শিশুদের কথা বিবেচনা করলে অনেক জায়গায় পিছিয়ে আছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারলে লক্ষ্য অর্জন হতে পারে। দেশের মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষক এসডিজি সম্পর্কে জানেন। সূচকগুলো সম্পর্কে ধারণা আছে এমন শিক্ষকের সংখ্যা ৫ শতাংশ। এ অবস্থায় গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে তিনি দাতা সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।