• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
অসহনীয় মাত্রায় শব্দদূষণ

অসহনীয় মাত্রায় শব্দদূষণ

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

অসহনীয় মাত্রায় শব্দদূষণ

হর্ন ও হেডফোনে কমছে শ্রবণশক্তি

  • রানা হানিফ
  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

যান্ত্রিক যানবাহনের হর্নের শব্দে অতিষ্ঠ দেশ। শব্দদূষণের প্রধান কারণ হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত হর্নের শব্দ। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্যে মোবাইল ফোনে ব্যবহূত হেডফোনের কারণে বাড়ছে বধির হওয়ার শঙ্কা। মোবাইল ফোনে ব্যবহূত হেডফোনে সর্বনিম্ন ৮০ থেকে ১২৫ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সৃষ্টি হয় যা স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি কমাতে যথেষ্ট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব মতে, বিশ্বের যুব সমাজের প্রায় একশ’ কোটিই হেডফোন ব্যবহারে অভ্যস্ততার কারণে রয়েছে শ্রবণশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে নয়শ’ কোটির বেশি।  আর শব্দদূষণের ক্ষতির দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ রয়েছে চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থানে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে শব্দদূষণ সর্বোচ্চ সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠী ৫ শতাংশ শব্দদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত সেখানে বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশে। 

শব্দদূষণ রোধে দেশে প্রচলিত আইন যথার্থ থাকলেও তা প্রয়োগের দুর্বলতা, সাধারণ মানুষের মধ্যে শব্দদূষণের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা না থাকার কারণে এই সঙ্কট আরো তীব্র আকার ধারণ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকারি সংস্থারগুলো সমন্বিত উদ্যোগের অভাব, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শব্দদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না।

গেল বছর পরিবেশ অধিদফতের চালানো এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় আটটি শহরের শব্দদূষণ যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে স্বাভাবিক শ্রবণক্ষমতার মানুষকে বধির করে দিতে সক্ষম। জরিপ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা পৌঁছে ১৩২ ডেসিবলে, চট্টগ্রামে ১৩৩ দশমিক ৪, খুলনায় ১৩০ দশমিক ৬, সিলেটে ১৩০ দশমিক ৬, রাজশাহীতে ১৩২ দশমিক ৮, বরিশালে ১৩১ দশমিক ৩, রংপুরে ১৩০ দশমিক ১ এবং ময়মনসিংহে এ মাত্রা পৌঁছেছে ১৩০ দশমিক ৭ ডেসিবল।

রাজধানীর মোট ৭০টি স্থানের ওপর চালানো এই জরিপে দেখা যায়, শব্দের মাত্রার ওপর নির্ভর করে রাজধানীতে সবচেয়ে নীরব এলাকা উত্তরার সেক্টর-১৪ এর ১৮ নম্বর রোডে। এই এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১০০ দশমিক ৮ ডেসিবল। আর সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দ পাওয়া যায় ফার্মগেট মোড় এলাকায়। জরিপে এই এলাকায় শব্দের মাত্রা ১৩৫ দশমিক ৬ ডেসিবল।

আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) শব্দের যে মানমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে দেখা যায়, মানমাত্রার স্বাভাবিক পর্যায়ের শব্দের মাত্রা আশা নির্ধারণ করেছে শূন্য থেকে ২৫ ডেসিবল আর ডব্লিউএইচ নির্ধারণ করেছে শূন্য থেকে ২০ ডেসিবল। হালকা শব্দের মাত্রা আশার তালিকায় রয়েছে ২৬ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং ডব্লিউএইচও তালিকায় তা ২১ থেকে ৪০ ডেসিবল। মাধ্যম পর্যায়ের শব্দের মাত্রা ৪১ থেকে ৫৫ ডেসিবল নির্ধারণ করেছে আশা আর ডব্লিউএইচও নির্ধারণ করেছে ৪১ থেকে ৭০ ডেসিবল। মধ্যম থেকে তীব্র পর্যায়ের শব্দের মাত্রা আশা তালিকায় রয়েছে ৫৬ থেকে ৭০ ডেসিবল। তীব্রতর পর্যায়ের শব্দের মাত্রা ৭১-৯১ ডেসিবল নির্ধারণ করেছে আশা আর ডব্লিউএইচও’র তালিকায় তা ৭১ থেকে ৯০ ডেসিবল আর অসহনীয় পর্যায়ের শব্দের মাত্রা আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন নির্ধারণ করেছে ৯১ ডেসিবলের উপরের শব্দকে আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় তা রয়েছে ৯১ থেকে ১২০ ডেসিবল।

আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটোর শব্দের মানমাত্রার তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে নীরব অঞ্চলটির শব্দও রয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে।

অঞ্চলভিত্তিক এই জরিপে দেখে যায়, রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার শাজাহানপুর এলাকা। এই এলাকায় দিন, সন্ধ্যা ও রাতে শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১৩৩ দশমিক ৬ ডেসিবল। আর সর্বনিম্ন বা নীরব এলাকা হিসেবে পাওয়া যায় উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়ক এলাকায়। এই এলাকায় শব্দের এই মাত্রা ছিল ১০০ দশমিক ৮ ডেসিবল।

মিশ্র এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে ফার্মগেট এলাকা, এখানে শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১৩৫ দশমিক ৬ ডেসিবল, আর সবচেয়ে কম দূষণের এলাকা হিসেবে রয়েছে সেগুনবাগিচা অঞ্চল। এই এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১৪ দশমিক ৬ ডেসিবল। নীরব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতেও শব্দদূষণের মাত্রা রয়েছে মানমাত্রা অসহনীয় স্তরে। জরিপ চালানো এলাকাগুলো থেকে দেখা যায়, মহাখালী আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল এলাকায় শব্দের মাত্রা ১২৯ দশমিক ৫ ডেসিবল, ধানমন্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয় এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ১২৮ দশমিক ১ ডেসিবল, আগারগাঁও শিশু হাসপাতাল এলাকায় শব্দের মাত্রা ১২৭ দশমিক ৯ ডেসিবল, বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এলাকায় ১২২ দশমিক ৯ ডেসিবল, সচিবালয় এলাকায় শব্দের মাত্রা ১১০ দশমিক ৯ ডেসিবল। উৎসের ভিত্তিতে শব্দদূষণে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মোটরযানের হাইড্রোলিক ও সাধারণ হর্নের শব্দকে। আর যানের ধরনের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেটকার) হর্ন থেকেই ঘটছে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের ঘটনা, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মোটরবাইক, তৃতীয় অবস্থানে সিএনজি থ্রি হুইলার। এরপর রয়েছে পিকআপ ভ্যান, বাস, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স, হিউম্যান হলারসহ অন্যান্য যানবাহন।

নির্মাণকাজে টাইলস, রড, থাই কাটার মেশিনের শব্দ থেকে বেশি পরিমাণ দূষণ ঘটছে, এরপরই রয়েছে ইট ভাঙার মেশিনের শব্দ। আর শিল্প-কারখানা অঞ্চলে শব্দদূষণের প্রধান উৎসই হচ্ছে জেনারেটর।

শব্দদূষণ রোধে করণীয় প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, শব্দদূষণ রোধে প্রথমেই উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। দেশের প্রচলিত যে আইন ও বিধিমালা আছে তা শব্দদূষণ বন্ধ করতে যথেষ্ট। তবে আইনের প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি শব্দদূষণের প্রধান কারণ মোটরযানের হাইড্রোলিক হর্ন ও অনিয়ন্ত্রিত হর্ন বাজানো বন্ধ করতে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য সংস্থারও দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্বশীল এসব সংস্থার সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন না ঘটালে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ। দেশে যেসব যানবাহন চলাচল করছে সেগুলো মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে হাইড্রোলিক হর্ন যুক্ত করে দেওয়া হয় না। হাইড্রোলিক হর্ন পরবর্তী যানবাহনের মালিক নিজে যুক্ত করেন। এখন বিষয়টি হলো গাড়ি ধরে ধরে হাইড্রোলিক হর্ন খুললে কোনো দিনই সমস্যার সমাধান হবে না। ধরতে হবে কারা হাইড্রোলিক হর্ন বাইরে থেকে আমদানি করছেন, কারা বিপণনের সঙ্গে জড়িত। আর বিআরটিএ যদি যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা যথাযথভাবে করে তাহলেই শব্দদূষণের এসব উৎস আর থাকবে না।

তিনি বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করেই শব্দদূষণ রোধ করা যাবে না। প্রথমই আমাদের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আর সেটা করতে হবে শব্দ উৎপাদনকারীদের মধ্যে। পাশাপাশি মোটরযান মালিক-শ্রমিকদের যে সংগঠন রয়েছে সেগুলোর ওপর থেকে রাজনৈতিক ছত্রছায়া সরিয়ে নিতে হবে, তাহলেই যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরবে আর বন্ধ হবে শব্দদূষণ।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads