• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
গতি আসেনি এডিপিতে

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)

সংরক্ষিত ছবি

জাতীয়

গতি আসেনি এডিপিতে

# সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়ন ৩৪ শতাংশ # পাঁচ মাসে ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের চাপ # অপচয়ের আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বেশি ব্যয়ের প্রবণতা থেকে বের হতে পারছে না সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এবার শুরু থেকেই প্রকল্পের পরিচালকরা (পিডি) অর্থ ছাড়ের সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারছেন না। ফলে এডিপি বাস্তবায়নে গতি আসেনি অর্থবছরের সাত মাসেও। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপির মাত্র ৩৪ দশমিক ৪৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সাত মাসে। শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে পাঁচ মাসে আরো ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত গতি না আসায় ইতোমধ্যেই কাটছাঁট করে সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ। পাশাপাশি শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে সব বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান নিজেই। এসব কাজ শেষ করে এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে আরো মাসখানেক সময় লাগবে। ফলে এডিপি বাস্তবায়নের পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাতে হলেও বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে শেষ প্রান্তিকে।

আইএমইডি সূত্র জানায়, গত অর্থবছর এডিপি বাস্তবায়নে ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে প্রথম ৯ মাসে ছাড় হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। আর শেষ তিন মাসে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উন্নয়ন ব্যয় দাঁড়িয়েছিল ৭৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। সারা বছরের এডিপি ব্যয়ের সাড়ে ৫১ ভাগ অর্থ ছাড় হয়েছিল অর্থবছরের শেষ তিন মাসে। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ব্যয় হয়েছিল ৪৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। এক মাসে এডিপির ৩৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করায় উন্নয়নকাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। যথাযথ কাজ না করে অর্থ উঠিয়ে নেওয়ায় সরকারি তহবিলের অপচয় হচ্ছে বলেও অভিযোগ অর্থনীতিবিদদের।

আইএমইডি সূত্র জানায়, গত অর্থবছর প্রথম সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল বরাদ্দের ৩৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছর এর হার ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর আগের বছর ২৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছিল সাত মাসে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৩৩ শতাংশ, ২১২-১৩ অর্থবছর ৩৮ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৪ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল। এ হিসাবে গত আট বছর ধরে বছরের শুরুতে এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুরুর দিকে উন্নয়নকাজে গতি আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাগিদ দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পত্র দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠিও দেওয়া হয়েছে দুই বছর আগে। চিঠিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ না হলে নতুন করে প্রকল্প অনুমোদন, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্প বাতিলেও নির্দেশনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। তবে এসব নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে কাজে আসছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা অনেক পুরনো সমস্যা। বছরের শুরু থেকে প্রকল্প ফেলে রেখে শেষ দিকে দায়সারা কাজ করা হয়। বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে অবহিত। বছরের শুরুতে কাজ করতে প্রতিবারই নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো নির্দেশনারই বাস্তবায়ন হয় না। তিনি আরো বলেন, একসঙ্গে বেশি প্রকল্প নেওয়ায় বাস্তবায়নে গতি আসে না। শেষদিকে কিছু কাজ করে টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এতে জনগণের কোনো কাজে আসে না।

আইএমইডি সূত্র জানায়, বেশি শীর্ষ বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে বেশ কয়েকটির বাস্তবায়ন হার সাত মাসেও হতাশাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে। এতে বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২০ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে মাত্র ৫ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বাস্তবায়নের হার ২৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ১০ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের মাত্র ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সেতু বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হার ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এ ছাড়া বড় বরাদ্দ পাওয়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সাত মাসে এডিপি বরাদ্দের ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ ব্যয় করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ অর্থ।

সূত্র জানায়, এডিপি বাস্তবায়নে এবার শুরু থেকেই গতি আসবে বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও শুনিয়েছিলেন শতভাগ এডিপি বাস্তবায়নের আশাবাদ। বাজেট উপস্থাপনের সময় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনতে শুরু থেকেই অর্থ ছাড় দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে ধাপে ধাপে অর্থ ছাড়ের কারণে সৃষ্ট স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসবে বাস্তবায়ন।

এরই অংশ হিসেবে প্রকল্প পরিচালকরা জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকেই প্রকল্পের অর্থ ছাড় করার ক্ষমতা পান। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে মুস্তফা কামাল শুরুতেই এডিপি বাস্তবায়নে গতি আনার তাগিদও দেন। নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানও প্রকল্পের গতি আনতে চলমান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজেই মাছে নেমেছেন। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের তিনি এ-সংক্রান্ত সভায় ডেকেছেন। এত উদ্যোগ সত্ত্বেও গতি আসছে না এডিপি বাস্তবায়নে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি সহায়তা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাস্তবায়নকারী সংস্থার তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। সাত মাসে সরকারের তহবিল থেকে ৩৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ খাতে বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ। বিদেশি সহায়তার ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ২২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা (৩৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ) ও সংস্থার তহবিলের ৩ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা (৩৯ দশমিক ৮১ শতাংশ) অর্থ ব্যয় হয়েছে সাত মাসে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads