• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
আজ শেষ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম মিলনমেলা

বিশ্ব ইজতেমা

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

আজ শেষ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম মিলনমেলা

  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়া, টঙ্গী থেকে

মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমার ৫৪তম আসর শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে লাখো মুসল্লির অংগ্রহণে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এই মহাসম্মেলনের সমাপ্তি ঘটবে। দিল্লির শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা সা’দ-এর অবর্তমানে আখেরি মোনাজাত ও হেদায়েতী বয়ান ইজতেমার জিম্মাদার দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা শামীম আহমদের পরিচালনা করার কথা রয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়াংশেও বিশ্বের কয়েকটি দেশের অগণিত মেহমান এসেছেন। গতকাল দ্বিতীয় দিনেও নানা ঝক্কি ঝামেলা উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইজতেমাস্থলে এসেছেন। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে শিল্পনগরী টঙ্গী যেন এখন ধর্মীয় নগরী। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের আসা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দিতে লাখো মুসল্লির ঢল টঙ্গীর এক সময়কার খরস্রোতা কহর দরিয়া ও তুরাগ নদের তীরস্থ বিশাল ময়দানমুখো। রেলপথ, সড়কপথ, নৌপথ, আকাশপথ এবং যানজট এড়াতে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা থেকে অনেকে পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে সমবেত হচ্ছেন। টঙ্গীর যেদিকে চোখ যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মুসল্লিদের দেখা মেলে। গত পর্বের মতো এবারো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সমাগমের স্রোতে টঙ্গীর ৪ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট শহরটি যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এ স্রোত থাকবে আজ আখেরি মুনাজাতের আগ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে ময়দানে আগত কয়েক লাখ মুসল্লি তাদের নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা আলাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনে ইবাদত বন্দেগি আর কোরআন হাদিসের আলোচনায় এখন বিশ্ব ইজতেমার বিশাল প্যান্ডেলে পবিত্র ধর্মীয় আবহাওয়া বিরাজ করছে।

দেশি-বিদেশি ইসলামী চিন্তাবিদ ও ওলামায়ে কেরামরা ছয় উসুল যথা-ঈমান, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমীন, তাসহীহে নিয়ত, দাওয়াত ও তাবলিগ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান বয়ান রাখছেন। মূল বয়ান সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষিদের মাঝে তরজমা করে শোনানো হচ্ছে। মুরুব্বিদের বয়ান চলাকালে পুরো ইজতেমা ময়দানজুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। সকালে মুসল্লিদের অধিক মনোযোগ সহকারে মুরুব্বিদের মূল্যবান বয়ান শুনতে দেখা গেছে। তুরাগ তীরবর্তী বিশাল প্রান্তরে নির্মিত পাটের চট ও নাইলন কাপড়ের প্যান্ডেল ইতোমধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে যারা আসছেন তাদের নিজ উদ্যোগে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান নিতে হচ্ছে।

ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে বয়ান ও বাংলায় ভাষান্তর করলেন যারা : গতকাল সোমবার বাদ ফজর উর্দুতে বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা মুরসালিন। তার উর্দু বয়ানের বাংলা তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুফতি আবদুল্লাহ মনসুর কাসেমি। এরপর তালিমের মুয়াল্লিমদের (মাদরাসার ছাত্রদের জন্য) উদ্দেশে বয়ান করেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মুফতি রিয়াছত আলী। তরজমা করেন মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ। বাদ জোহর বয়ান করেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মুফতি শেহজাদ। তরজমা করেন মাওলানা মনির বিন ইউসুফ। বাদ আসর বয়ান করেন তাবলিগের শূরা সদস্য বাংলাদেশের বুজুর্গ ওয়াসিফুল ইসলাম। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা শওকত। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মুফতি জিয়া বিন কাসেম। আজ বাদ ফজর বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা ইকবাল হাফিজ। তরজমা করেন মুফতি উসামা ইসলাম। হেদায়েতী বয়ান করবেন দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ, ইজতেমার জিম্মাদার ও শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা শামীম আহমদ। তরজমা করবেন মাওলানা আশরাফ আলী। গতকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশে বয়ান করেন মাওলানা ইকবাল হাফিজ ও এলাহাবাদের মাওলানা শাহেদ। খাওয়াছদের (ভিআইপি) উদ্দেশে বয়ান করেন দিল্লির মুফতি সাজিদ। বধিরদের উদ্দেশে বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মুরুব্বি মাওলানা ওমর মেওয়াতি। আরবি খিত্তায় বয়ান করেন বাংলাদেশের  মাওলানা আবদুল্লাহ। ইংরেজি খিত্তায় বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের  প্রফেসর লিয়াকত। মালয়েশিয়া খিত্তায় বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মুফতি শেহজাদ ও মুফতি রিয়াছত। উর্দু খিত্তায় বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা শওকত। রুশ (রাশিয়া) খিত্তায় বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের প্রফেসর মো. নওশাদ। চায়না খিত্তায় বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মাওলানা আসআদ। আরবি ত্বালাবা বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের মুফতি রিয়াছত ও মাওলানা ফারহান। তাদের বয়ান ভাষান্তর করেন মাওলানা মুয়াজ বিন নূর।

যাদের দ্বায়িত্বে সা’দ অনুসারীদের বিশ্ব ইজতেমা : মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী হিসেবে পরিচিত দ্বিতীয়াংশের ইজতেমার যাবতীয় কাজ সম্পাদনে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ থেকে এসেছেন তাবলিগের নবীন-প্রবীণ মিলে ৩৩ মুরুব্বির একটি প্রতিনিধি দল। এ প্রতিনিধি দলের জিম্মাদার হিসেবে আছেন মাওলানা শামীম আহমদ। নিজামুদ্দিনের এসব মুরুব্বিদের মধ্য থেকেই মাসোয়ারার মাধ্যমে দ্বিতীয়াংশের ইজতেমায় বয়ান ও আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়াংশের ইজতেমা জিম্মাদার মাওলানা শামীম আহমদ ছাড়াও এ প্রতিনিধিদলে রয়েছেন মাওলানা শওকত, মাওলানা ওমর মালিক, মুফতি শেহজাদ, মাওলানা হাশিম বিন শামীম, মাওলানা আসাদুল্লাহ, মাওলানা যুয়ারুল হাসান, মিয়াজি মাওলানা ফুল, মুফতি শরিফ, মাওলানা জামসিদ, মাওলানা মো. মুরসালিন ও বিশ্ব বিখ্যাত আলেম ইউসুফ সালানির সন্তান মাওলানা ইয়াকুব। অপরদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের তাবলিগি দায়িত্বশীলদের মধ্য থেকে উপস্থিত রয়েছেন মাওলানা নাফিস, মুফতি আবদুর রহিম, শায়খুল হাদিস আবদুর রশিদ, মাওলানা আবদুল হান্নান, মাওলানা শামসুর রহমান, মাওলানা গাজাইল, প্রফেসর আবদুল আলিম, শায়খ ইলিয়াস (বাড়াবাকিং), শায়খ আলাউদ্দিন (মেওয়াত), মুফতি আবদুল সাত্তার, শায়েখ ইউসুফ, মিয়াজি আজমত, মুফতি শওকত। ৩৩ সদস্যের বিশাল এই বহর দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের ৩১ জন ইতোমধ্যে কলকাতা হয়ে সড়কপথে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন।

বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণ : প্রতিবারের মতো বিদেশি মেহমানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ময়দানের উত্তর পশ্চিম কোণে টিনের কামরায় আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবার বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি উপস্থিত না থাকলেও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের কয়েক শত বিদেশি মেহমান গতকাল বিকাল পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। বিভিন্ন মহাদেশ ও ভাষাভাষী অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশি মেহমানরা ভিন্ন ভিন্ন তাঁবুতে অবস্থান করছেন। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে বিভক্তি : গাজীপুর জেলার টঙ্গীর কহর দরিয়া ও তুরাগ নদের তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা হলো সুন্নি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় তাবলিগ জামাতের বার্ষিক আন্তর্জাতিক মহাসমাবেশ। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির জমায়েতের ফলে বিশ্ব ইজতেমাকে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসম্মেলন এবং হজের পরই রয়েছে এর স্থান বলে মনে করা হয়। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হলেও তাবলিগ জামাতের দু-গ্রুপের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে এবার তা পিছিয়ে শুরু হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে। তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছের নাতি দিল্লির মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ কান্ধলভির হাতে থাকবে, না দেওবন্দ মাদরাসার মাওলানা জুবায়েরের ছেলে জুহাইরুল হাসানের অনুসারীরা এর নেতৃত্ব দেবেন তা নিয়ে শুরু হয় এই বিভক্তি। এ বিভক্তির কারণে গত বছর বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতে ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন সা’দ। পরে সরকারের মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়। এ বছর তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ জানুয়ারির দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিশ্ব ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে সেই উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। ইজতেমা মাঠে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুও হয়।

এরপর গত ২৪ জানুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তাবলিগের দুই পক্ষের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে সমঝোতায় আসেন এবং এবারের ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করা হয়। দুই পক্ষের মতের মিল না হওয়ায় আয়োজনেও কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। আগে তাবলিগ জামায়াতের মুরুব্বিরা ইজতেমার ব্যবস্থাপনায় থাকলেও এবার তা স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলাকে ভাগ করে গত কয়েক বছর ধরে দুই ভাগে ইজতেমার আয়োজন করা হতো। এবার একসঙ্গে চার দিনের ইজতেমার আয়োজন করা হয়েছে। তবে মোনাজাত দু-ভাগে হবে বলে জানিয়েছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বিরা। এতে করে ইজতেমায় সেই দ্বন্দ্বের রেশ থেকেই যাচ্ছে। শুক্র ও শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে দেওবন্দ মাদরাসার মাওলানা জুবায়েরের ছেলে জুহাইরুল হাসান অনুসারীদের ইজতেমা এবং গত রোববার থেকে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছের নাতি দিল্লির মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ কান্ধলভি অনুসারীদের ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মোনাজাত।

মোনাজাতের দিন চলবে শ্যাটল বাস :  মোনাজাতের দিন আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে গাজীপুরের চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকা থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত মুসল্লিদের সুবিধার্থে অগণিত বিআরটিসি বাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন (ইজতেমার স্টিকার লাগানো) বাস চলাচল করবে। এ ছাড়া ২২টি বিশেষ ট্রেন টঙ্গী থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করবে।

এসব বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, আজ আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দু’পক্ষের বিশ্ব ইজতেমার ৫৪তম আসর। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার মুসল্লিরা ময়দানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল রয়েছেন। আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। আখেরি মোনাজাত শেষে ময়দান খালি না হওয়া পর্যন্ত তারা ময়দানে কাজ করবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads