• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বাংলা বানানে যথেচ্ছাচার

বাংলা বানানে যথেচ্ছাচার

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

বাংলা বানানে যথেচ্ছাচার

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

শহীদদের রক্তে ভেজা বর্ণ দিয়ে সাজানো বাংলা বানানে চরম নৈরাজ্য চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়ক বই থেকে শুরু করে ব্যবহারিক বাংলায় বিরাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘নিজস্ব নিয়মের যথেচ্ছাচার’। বাংলা বানানে এক ধরনের সমতা আনতে সরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় একই প্রমিত রীতি অনুসরণের কথা থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানেই তা মানা হচ্ছে না। ফলে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও বাংলা বানানে সমতা আসছে না।

উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রায় পাঁচ বছর পরও সব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডে বাংলা লেখা নিশ্চিত করা যায়নি। মালিকরা নিজের খেয়ালখুশি মতো ও প্রায় ক্ষেত্রে অজ্ঞতাবশত ভিন্ন ভাষায় সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড লিখিয়ে প্রতিষ্ঠানের সামনে টানিয়ে রাখছেন। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে সরকারি যেসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের কথা রয়েছে, সেগুলো এ বিষয়ে শুধু আদেশ বা চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে বলে অভিযোগ আছে। কখনো কখনো অভিযান চালিয়েই সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায় সারেন। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না, কিংবা চিঠির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি-না, এসব বিষয়ে নিয়মিত তদারকি নেই। বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার বাধ্যবাধকতার আইন ও আদেশের বিষয়ে অনেকের জানা না থাকলেও তাদের সচেতনতা সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্টদের নেই কোনো কার্যক্রম।

তথ্য মতে, ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দফতরের নামফলক ও গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। পাঁচ বছর পরও আদালতের রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের অন্য বিভাগীয়, জেলা ও মফস্বল শহরে অহরহ চোখে পড়ে বিদেশি ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড। বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে নানা বিলবোর্ড বানাচ্ছে। ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় আজো প্রতিষ্ঠা পায়নি শুধু মায়ের ভাষায় সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড লেখার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি।

সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এছাড়া বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সরকারি কার্যালয়, আদালত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ বায়ান্ন সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পূর্ণ হতে চললেও আজো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সরকারেরও যেন নেই সর্বজনীন কোনো বানানরীতি। সরকারি কার্যালয়ের ভবনের সাইনবোর্ড, প্রজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি লেখা হচ্ছে সাধু ও চলিত শব্দের ‘দূষণীয়’ মিশ্রণে।

ভাষাবিদদের মতে, দেশের মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে। তবে ভাষার ব্যবহারে সচেতনতা উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যেই নেই। কথ্য ভাষায় উচ্চারণে অসতর্কতা, বিকৃতি যেমন লক্ষণীয়; তেমনি বানানের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিও ব্যাপক। তাদের কথা বলায় এর প্রমাণ মেলে। বাংলা বানান লেখার বেলায়ও তাদের অবজ্ঞা চোখে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা একে ‘বাংলা ভাষার টিকে থাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে অভিহিত করছেন।

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান মনে করেন, ‘বাংলা বানান নিয়ে অসচেতনতার একটি বড় কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলার প্রতি অবহেলা। ভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর বোধ সৃষ্টি করতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের দায়িত্ব আছে। তিন ক্ষেত্রেই আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলা বানানে সমতা আনতে বাংলা ভাষার গবেষণা ও অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রমিত বানানরীতি প্রণয়ন করে। এর আগে পাঠ্যবইয়ের বানানের বিশৃঙ্খলা দূর করতে ১৯৮৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও (এনসিটিবি) বানানরীতি প্রণয়ন করে। বাংলা একাডেমি ও এনসিটিবির বানানরীতিতে মৌলিক কোনো অমিল না থাকলেও সমতা আসছে না। দুটি প্রতিষ্ঠানই মূলত প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের কথা বললেও সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বানানরীতিতে সমতা নেই। বিভিন্ন শ্রেণির নোট, গাইড বইয়ের লেখকরা প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করছেন না। তাদের বই মুখস্থ করে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ বানানে অভ্যস্ত হতে পারছে না।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ফেসবুকসহ অনলাইনকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগের অন্য মাধ্যমে লেখা অশুদ্ধ বাংলা দেখা যায়। তাতে বানানের বিষয়ে তাদের সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি প্রমিতরীতির বিষয়ে যথাযথ ধারণা না রাখার বিষয়গুলোও প্রকট হয়ে উঠছে।

কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও আবার ‘নিজস্ব’ বানানরীতি আছে। বাংলা একাডেমি ও এনসিটিবির বানানরীতি অনুযায়ী বিদেশি শব্দ লেখা হয়ে থাকে ‘হ্রস্ব-ই-কার’ দিয়ে। সরকারি আরেক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ রীতি মানে না। আরবি, ফারসি শব্দ বিদেশি ভাষার হলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এসব শব্দ লেখে ‘দীর্ঘ-ঈ-কার’ দিয়ে। বাংলা একাডেমি এখন ‘একাডেমি’ শব্দটি ‘হ্রস্ব-ই-কার’ দিয়ে লিখলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান শিশু একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী এখনো লেখে ‘দীর্ঘ-ঈ-কার’ দিয়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বানান নৈরাজ্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে দেশি প্রচারমাধ্যমগুলো। তবে প্রচারমাধ্যমগুলোর বাংলা বানান ও উচ্চারণ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো পত্রিকার নিজস্ব বানানরীতি আছে। কোনো কোনো পত্রিকা বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করলেও বিশেষ বানানের ক্ষেত্রে নিজেদের সাজানো রীতিকে প্রাধান্য দেয়। বানানের ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেলগুলোর অসতর্কতা প্রায়ই বিতর্কের জন্ম দেয়। বেসরকারি এফএম রেডিওগুলোর অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণসহ উটকো উচ্চারণের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনা চলে আসছে।

সরেজমিন গেলে দেখা যায়, বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক হলেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। পল্টন, শ্যামলী, গুলিস্তান, মতিঝিল, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, মগবাজার, তেজগাঁও ও উত্তরা এলাকার অনেক সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। ঢাকার সব এলাকার চিত্র প্রায় একই রকম। বাংলা লিখতে হবে, আদালতের এ আদেশের কথা অনেকেই জানেন না। আবার ‘ট্রেড লাইসেন্স’ (ব্যবসা করার অনুমতি) নেওয়ার সময় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত একটি সিল দিয়ে ট্রেড লাইসেন্সে লেখা থাকে, ‘সাইনবোর্ড/ব্যানার বাংলায় লিখতে হবে’। এরও প্রতিফলন নেই সবখানে। দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও এসব বিষয়ে নেই নিয়মিত তদারকি। অভিযোগ আছে, বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (উত্তর সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) হলেও তা কার্যকরে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads