• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
বাংলা ভাষার নিজস্বতা ধরে রাখতে হবে

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

বাংলা ভাষার নিজস্বতা ধরে রাখতে হবে

  • মোহাম্মদ অংকন
  • প্রকাশিত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতি ফেব্রুয়ারি মাসকে নিয়ে গর্ববোধ করে। এই মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমরা কতজন বাঙালি এর সঠিক মূল্যায়ন করছি? সর্বত্র বাংলা ভাষার অপব্যবহার, অপপ্রয়োগ, বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্র ব্যবহার, অশুদ্ধ উচ্চারণ, বানানগত সমস্যাই বলে দেয় ভাষার মাস শুধু গতানুগতিক একটি ইংরেজি বর্ষের মাস, বাংলা ভাষা অর্জনের ইতিহাসকে বিশেষভাবে স্মরণ করার মাস নয়! ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা হারাতে চলেছে। এই মাসের মর্যাদা রক্ষার্থে আমাদের লিখন-পঠনে যেমন বাংলা ভাষা ব্যবহারে অধিকতর সচেতন হতে হবে ও শুদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে, তেমনি বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলার নিজস্বতা ধরে রাখার দিকে সুনজর দিতে হবে। 

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা, স্বকীয়তা ও মৌলিকতা থেকে আজ বিচ্যুতির পথে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, যেখানে সহজ বাংলা শব্দ ব্যবহার করেও বাক্যকে অর্থবোধক ও বোধগম্য করানো সম্ভব, সেখানেও ইংরেজি, হিন্দি কিংবা অন্য ভাষার শব্দ জুড়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে চরমভাবে বিকৃত করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার এমন মিশ্রণপ্রবণতা বাঙালি জাতির সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে।  

বাংলা ভাষার এই গুরুচণ্ডালী দূষণ ঘটাতে শিক্ষিত শ্রেণি, অফিস-আদালতের কর্মচারী, টেলিভিশন, রেডিও, চলচ্চিত্রের শিল্পী-কলাকুশলীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত পারদর্শী। এসব ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত হারে বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ হয়ে থাকে। বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ যেন এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে গেছে। কেউ যদি শুধু বাংলায় কথা বলে, তাহলে তাকে অপবাদ দেওয়া হয় যে, সে ইংরেজিতে (বা অন্যান্য ভাষায়) কথা বলতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে, আমরা ইংরেজি কিংবা অন্যান্য ভাষা ব্যবহার করব না তাহলে? অবশ্যই প্রয়োজনের স্বার্থে অন্যান্য ভাষা ব্যবহার করব। তবে সব ভাষার নিজস্বতা বজায় রেখে। যখন ইংরেজিতে কথা বলব, তখন শুধু ইংরেজিতেই কথা বলব। আধো বাংলা, আধো ইংরেজি বলার প্রবণতা হ্রাস করতে হবে। যদি একান্তই ইংরেজিতে কথা বলার প্রয়োজন হয়, তাহলে ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। শুধু একক বাংলা ভাষায় কথা বলতে পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অভ্যাসগত পরিবর্তন আনা জরুরি।  

বাংলার মধ্যে অন্যান্য ভাষার যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা কখনোই নির্মূল করা সম্ভব নয়। কেননা কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্রসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ লক্ষণীয়। অনেকে বলবেন হয়তো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন রয়েছে, হতেও পারে। তবে আমরা বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভাষার মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি যা আমাদের অভ্যাসগত ভাষার মিশ্রণকে রোধ করতে সহায়ক হবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নামকরণে এবং এগুলোর প্রচার প্রসারে আমরা শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারি। ইদানীং প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনেই বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ ও বিকৃতকরণ বেশি চলছে। অনেকাংশে একটি মৃত্যুর সংবাদ, নির্বাচনী প্রচারণা, অন্যান্য বিজ্ঞপ্তি প্রচারে অহরহ বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষা গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ বর্তমানে মারাত্মক ও মহামারী আকার ধারণ করেছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই জরুরি এবং এক্ষেত্রে সঠিক বাংলা ভাষা ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। 

বর্তমানে সঙ্গীত, কাব্য, গল্পে বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। সঙ্গীত ও কবিতার চরণের মিলবিন্যাসের স্বার্থে লেখক ও নির্মাতারা একক বাংলা ভাষা ব্যবহারে অসচেতন, অনাগ্রহী। বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার মিশ্রণ করে সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীতচর্চা করা সত্যিই দোষণীয়। শুধু তা-ই নয়, এ যেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অবমাননা করা। যারা ভাষার উৎকর্ষতা সাধন নিয়ে কাজ করেন, সৃষ্টিশীল কাজকর্ম করেন, তারাই যদি বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ করেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, সে বিষয়ে আমাদের কি কিঞ্চিৎ ভাবনা রয়েছে? আর এ কথা সবার স্মরণ রাখা দরকার যে, বিকৃত ভাষারূপ কখনোই কোনো জাতির জন্য হিতকর হতে পারে না। 

বাংলা ভাষা আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এর যথাযথ ব্যবহার ও রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। বাংলা ভাষাকে মিশ্রণ ও বিকৃতকরণ যেন বাংলা ভাষার জন্য জীবনদানকারী শহীদদের অপমান-অপদস্থ না করে। তাদের অপমান মানে আমাদের বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। ১৯৫২ সালের সেই দিনগুলোকে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা। কিন্তু কিছু ব্যক্তির কারণে পৃথিবীর বুক থেকে বাংলা বিজাতীয় ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে তা আমাদের সচেতন মহলকে যে কোনো উপায়ে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রয়োজন প্রতিটি দিন ভাষার শুদ্ধাচারে কাজ করা। একজন শিক্ষকের হাত ধরে যেমন শিক্ষার্থীরা সঠিক বাংলা ভাষা ব্যবহারে উৎসাহিত হতে পারে, কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গায় শুধু সদিচ্ছাই পারে শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার।  

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ভাষার বিচারে আমরা বহুভাষি। ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় ভাষা। এ ছাড়া আরো অসংখ্য ভাষা আমরা বেওয়ারিশভাবে প্রয়োগ করে থাকি। আমাদের ভাষায় আঞ্চলিকতা আছে, আন্তর্জাতিকতা আছে। তবে বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে ব্যবহারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই নিয়ন্ত্রণহীনতা বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে চলেছে। বাংলাকে তার নিজস্বতার পথ থেকে বিতাড়িত করে চলেছে। সর্বত্র বাংলা ভাষার অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ হচ্ছে। ভাষা বিকৃতির এই ক্রমধারা বন্ধ করতে হবে। নতুবা বাঙালি জাতিকে আবারো ভাষা নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে, হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়। তাই সময় থাকতে আমাদের শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহারে মনোনিবেশ করতে হতে হবে। সব ভাষার নিজস্বতা বজায় রেখে মাতৃভাষার সঠিক ব্যবহারে উৎসাহিত হতে হবে। তবেই ভাষাশহীদদের পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব যথাযথভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads