সরকারি বন্ধের দিন থাকায় গতকাল শুক্রবার বইমেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রচুর লোক সমাগম দেখা গেছে। কোলের ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ এসেছেন বইমেলায়। তবে গতকালের মেলায় কিশোরদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ করার মতো।
কিশোরদের মন বৈচিত্র্যময় থাকে। তারা কী বই পছন্দ করে, কী পড়তে ভালোবাসে, তা বোঝা সহজ নয়। কিশোরদের এই বিচিত্র্য মানস-পৃথিবী স্পর্শ করতে অনেক লেখকই লিখেছেন বিভিন্ন ধরনের বই। আর কিশোররাও খুঁজছে একটু অন্যকিছু। গতকাল মেলা ঘুরে দেখা গেছে, কিশোরদের জন্য অধিকাংশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে নানা ধরনের বই। তবে বর্তমানে কিশোররা ভূত-প্রেতের গল্প-উপন্যাসে আগ্রহ বোধ করে না। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে তাদের চিন্তার জগৎ যেমন প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি কৌতূহলও বাড়ছে।
বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোরসমগ্র, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু’, আনিসুল হকের কিশোর-তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক বই ‘সফল যদি হতে চাও’, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের কিশোর অ্যাডভেঞ্চার গ্রন্থ ‘বান্দরবানের জঙ্গলে’, আয়মান সাদিক ও অন্তিক মাহমুদের ‘ভাল্লাগে না’, চমক হাসানের ‘নিমিখ পানে : ক্যালকুলাসের পথ ভ্রমণ’, আদিত্য অনীকের ‘ছন্দা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’সহ গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কিশোরদের জন্য নানা ধরনের গল্প-উপন্যাস, কবিতা-ছড়াগ্রন্থ। আর এসবের প্রতিই কিশোর-পাঠকদের আলাদা রকমের আগ্রহ দেখা গেছে।
বাংলা একাডেমির দেওয়া তথ্যমতে গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৩১৪টি। গল্পগ্রন্থ ৪০, উপন্যাস ৩৩, প্রবন্ধ ১৮, কবিতা ১২৪ ও অন্যান্যবিষয়ক গ্রন্থ ৯৯টি।
এদিন বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ : ফিরে দেখা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. মাহবুবুল হক। আলোচনায় অংশ নেন সাইফুদ্দীন চৌধুরী, আলী হোসেন চৌধুরী এবং এম আবদুল আলীম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী।
তারা বলেন, বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে শতবর্ষ আগে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত দুটি সাহিত্য পত্রিকা। এর একটি হচ্ছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোজাম্মেল হক সম্পাদিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। সবশেষে বলব, এই সময়ের সাহিত্য সাময়িকীগুলো বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা সেই বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাছাড়া বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকায়ত জীবন ও লোকসংস্কৃতির উপাদান তুলে ধরাকে পত্রিকাটি অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মনির্ভর সাহিত্যচর্চার প্রবল ধারার মধ্য থেকে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যচর্চার একটা ধারা লক্ষ করা গিয়েছিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়। শতবর্ষের সাধনায় সে ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে।
আলোচকরা বলেন, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা হয়ে উঠেছিল বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রার অন্যতম বাহন। নামে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা হলেও এ সাময়িকপত্রটি অসাম্প্রদায়িক মানববাদের চর্চা করেছে। বিশেষত এ পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাসমূহ ইহজাগতিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রগতিশীল বিকাশের চিন্তাকে ধারণা করেছে বিপুলভাবে।
সভাপতির বক্তব্যে আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শতবর্ষ প্রকৃতপক্ষেই এক উদযাপনীয় বিষয়। শতবর্ষ আগে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার বাহন হিসেবে যে সাময়িকপত্র তিমিররাত্রি ভেদ করে উদার ভোরের বার্তা নিয়ে এসেছিল; সে পত্রিকা নিয়ে বাংলা একাডেমির বিশেষ আয়োজন ধন্যবাদের যোগ্য।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন আলমগীর রেজা চৌধুরী, মোস্তফা সেলিম, মোহাম্মদ সেলিম, সাধনা আহমেদ এবং খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি কুমার চক্রবর্তী, জাহানারা পারভীন, মুস্তাফিজ শফি, মাহবুব আজীজ, তুষার কান্তি দাশ, মাজুল হাসান, প্রত্যয় জসীম ও আয়শা ঝর্ণা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ফয়জুল আলম পাপ্পু ও মো. মাহমুদুল হাকিম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল লায়লা হাসানের পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নটরাজ’, সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’, নাঈম হাসান সুজার পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘নৃত্যজন’ এবং ইমন চৌধুরীর পরিচালনায় নৃত্যসংগঠন ‘ফাল্গুনী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংস্থা’র শিল্পীদের পরিবেশনা।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতার পুরস্কার প্রদান : সকাল সাড়ে ১০টায় অমর একুশের উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা : ক-শাখায় আনায়া জাকির হোসেন (প্রথম), এসএম নাহিয়ান (দ্বিতীয়) এবং তাহেরুননেসা রিচি (তৃতীয়); খ-শাখায় আল মুমিনুর (প্রথম), অর্নিলা ভৌমিক (দ্বিতীয়) এবং মেহেনাজ আক্তার নাদিয়া (তৃতীয়); গ-শাখায় আফরিদা ফারহানা খান (প্রথম), নবনীতা হালদার (দ্বিতীয়) এবং নাফিসা তাবাসসুম অথৈ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর সঙ্গীত প্রতিযোগিতা : ক-শাখায় সুবরানা আলী সোহা ও তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (প্রথম), সহিষ্ণু আইচ ও সিদরাতুল মুনতাহার (দ্বিতীয়), আফরা আদিলা রিমঝিম ও জাহিন জারা তাবাসসুম (তৃতীয়)। খ-শাখায় গার্গী ঘোষ ও তানিশা জাহান নরিকা (প্রথম), মো. রেজওয়ানুল করিম তানভীর ও অধরা সরকার (দ্বিতীয়) এবং উম্মে তাসনিয়া বুশার ও মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা : নিসার বিন সাইফুল্লাহ জাহিন (প্রথম), কাশফিয়া কাওসার চৌধুরী (দ্বিতীয়) এবং শাঁওলী সামরিজা (তৃতীয়)।
সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা : মো. মুনতাজিম রহমান সায়মন (প্রথম), নুসাইবা নাজমী খান ও তাইয়্যেবা (দ্বিতীয়) এবং মো. শাহারিয়ার আহম্মেদ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুরা লেখাপড়া করে শুধু ডাক্তার-প্রকৌশলী হবে এমন নয়। সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে তারা বিশ্ববিখ্যাত হতে পারে। আমি আশা করি আমাদের শিশুরা একদিন তাদের মেধা ও মনন দিয়ে আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আজকের অনুষ্ঠান : আজ শনিবার মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা : অতীত ও বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মাহরুখ মহিউদ্দিন। আলোচনায় অংশ নেবেন ফরিদ আহমেদ, মোহাম্মদ ইশতাক হোসেন এবং এএফএম হায়াতুল্লাহ। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।