• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ঘরে ঘরে কেমিক্যাল

পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

ঘরে ঘরে কেমিক্যাল

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নিমতলী ট্র্যাজেডির পরও পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা কমেনি। বরং এই ব্যবসা আরো দ্বিগুণ হয়েছে। পুরান ঢাকার সরু গলির বাসা-বাড়িতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে কেমিক্যালের গুদাম। বিশেষ করে নিমতলী, চকবাজার, মিটফোর্ড রোড, উর্দুরোড, ইসলামবাগ, লালবাগ ও বংশালে কেমিক্যালের অবৈধ বাণিজ্য। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলে মনে হবে পুরান ঢাকার মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে দাহ্য পদার্থ। বাসা-বাড়ির সবখানেই দাহ্য পদার্থে ঠাসা পুরান ঢাকা। এসব এলাকার ছোট ছোট বাড়িতে গড়ে উঠেছে নামি-দামি ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনীর কারখানা। নকল প্রসাধনী তৈরিতে এসব কারখানায়ও কেমিক্যালের যথেচ্ছ ব্যবহার হয়।

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের বেসমেন্টে পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের মজুত। যেখানে আগুন ছড়ালে পরিস্থিতি হতো আরো ভয়ঙ্কর। চকবাজারে শুধু ওয়াহিদ ম্যানশনেই নয়। এই এলাকার আশপাশের অলিতে গলিতে রয়েছে রাসায়নিকের মজুত। প্রতিটি মহল্লায় ছড়িয়ে আছে কেমিক্যালের রমরমা বাণিজ্য। চকবাজারের পাশেই ছোট কাটারা ও বড় কাটারা ধরে ইমামগঞ্জ ও মিটফোর্ট পর্যন্ত কেমিক্যাল গুদাম। চুড়িহাট্টার পাশে হাজী বাল্লু রোডের সরু গলিতে ঢুকলেই মিলবে অবৈধ কেমিক্যালের গুদাম।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যালের গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ।

সংগঠনটির চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কারণে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। আর এই প্রভাবের কারণেই এসব এলাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরানো যাচ্ছে না। পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের গুদাম দ্রুত সরিয়ে না নিলে আরো ভয়াবহ ট্র্যাজেডি হতে পারে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো ব্যবসা করছে এগুলো বৈধ নয়। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই। এরা একদম বেপরোয়া। কয়েকবার অগ্নিকাণ্ড হলেও পুরান ঢাকার সর্বত্র পড়ে থাকছে ভয়ঙ্কর সব দাহ্য পদার্থ। যেসব দ্রব্যাদিতে সামান্য আগুনের স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

গতকাল শনিবার চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের ভবনটির বেসমেন্টে থাকা কেমিক্যাল অপসারণের কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। অপসারণ কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টের কেমিক্যাল অপসারণ কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর এর মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ কাজ শুরু হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গোডাউন স্থানান্তর অপসারণ না হবে ততক্ষণ এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এখনো যেসব বাড়ির মালিকরা কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের উদ্যোগ নেননি সেসব বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে ২০১৭ সালের মার্চে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামগুলো সরানোর লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একবার অভিযান শুরু করলেও কয়েকদিনের মাথায় তা থেমে যায়। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন তুলে দেওয়ার জোরালো দাবি উঠলেও নকল ও ভেজাল প্রসাধনীর কারখানা মালিকরা অনড়। চোখের সামনেই ভয়াবহ আগুনে বৃহৎ প্রাণহানির ঘটনায়ও তাদের টনক যেন এতটুকু নড়েনি।

হাজী বাল্লু রোডের বাসিন্দা সুবা মিয়া জানান, ‘আগুন তো ওই হানে লাকছে (চুড়িহাট্টায় লেগেছে)। আমগো হেনে (আমাদের এখানে) তো লাগে নাইক্কা। আমরা যামু কেলা (আমরা কেন যাব)। আমরা সিজিলেই (নিরাপদেই) কাম কাজ করি। হেনে আগুন লাগনোর ডর নাই।’

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত ওয়াহেদ ম্যানশনেও মিলেছে ভেজাল প্রসাধনী কারখানার। ওই কারখানায় থাকা লাখ লাখ বোতল পারফিউম ও পারফিউম তৈরির কাঁচামাল আগুনের ধ্বংসযজ্ঞ বাড়িয়েছে বহুগুণ। এই ট্র্যাজেডিতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলার এই অংশ। যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পারফিউম, বডি স্প্রেসহ নানা সামগ্রী। এই সামগ্রীগুলোর প্রত্যেকটিতেই যে লেবেল রয়েছে সেগুলোয় উন্নত দেশের নাম রয়েছে। যদিও এলাকাবাসী বলছেন এর একটি সামগ্রীও বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো না।  সবগুলোই এখানে উৎপাদন হতো এবং এখান থেকেই বাজারজাত করা হতো। আর এই সামগ্রীগুলোই কিন্তু আগুনের মাত্রা বাড়িয়েছে।

ভবনটির পুরো ফ্লোর জুড়েই লাখ লাখ বোতল। যার অধিকাংশই গলে গেছে আগুনের তাপে। তবে যে কয়টি এখনো অক্ষত রয়েছে তার কোনোটিতে স্পেন, কোনোটিতে জার্মানি, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের লেবেল। আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে এভাবে দাহ্য পদার্থের কারখানা গড়ে উঠলেও বিষয়টি জানেন না কেউই। এই ভবনটির শুধু দ্বিতীয় তলাই নয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়ও ছিল এমন দাহ্য পদার্থের মজুত। সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে এসব সামগ্রী।

চকবাজারের বাইরেও পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায়ই ছড়িয়ে পড়ছে এমন অবৈধ-নকল প্রসাধনীর কারখানা। এর পেছনে বাড়িওয়ালাদের বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার মানসিকতা।

এ বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. শামসুল আরেফিন বলেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই ওই এলাকার ঠিকানায় একটি লাইসেন্সও দেওয়া হয়নি। ওই এলাকায় বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্স আছে এমন গুদামের সংখ্যা হাতেগোনা। বাকিগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। যাদের লাইসেন্স নেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কেমিক্যালের কারণেই সেদিন আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের ময়দানে পরিণত হয় চুড়িহাট্টা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এতে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো অর্ধশত মানুষ। তাদের ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসাধীন ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads