• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রিয়জনের দেহাবশেষ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ দালান

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

প্রিয়জনের দেহাবশেষ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ০১ মার্চ ২০১৯

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও প্রিয়জনের দেহাবশেষ পেতে অপেক্ষায় রয়েছেন নিহতদের স্বজনরা। সরকারি হিসাব মতে, এ ঘটনায় ৬৯ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ জনের মরদেহ ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। হাসপাতালগুলোর মর্গে এখনো ১৯ মরদেহ রয়েছে। এসব মরদেহের পরিচয় শনাক্তে ৪৯ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

নিহতদের স্বজনরা প্রিয়জনের শেষ চিহ্নটুকু পেতে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও সিআইডির কাছে বার বার ছুটে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই তারা প্রিয়জনের মরদেহ পাওয়ার আশায় খোঁজ নিচ্ছেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, চুড়িহাট্টায় নিহতদের মধ্যে ১৯টি মরদেহের পরিচয় শনাক্তে কাজ চলছে। তবে এসব মরদেহের একাধিক দাবিদার। ফলে অনেকেরই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৪৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের দিন লোহারপুল থেকে যাত্রী নিয়ে চকবাজারে যান রিকশাচালক মো. শাহাবুদ্দীন। এরপর তিনি অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়েন বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন। প্রিয়জনের শেষ চিহ্ন হিসেবে মরদেহটা পেতে তার পরিবারের স্বজনরা ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে শাহাবুদ্দীন কামরাঙ্গীরচরে থাকতেন। তার বাড়ি ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার মধ্য জয়নগর গ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে লোহারপুল এলাকা থেকে যাত্রী নিয়ে চকবাজারে আসেন তিনি।

চুড়িহাট্টায় প্লাস্টিকের ব্যবসা করতেন ফয়সাল সারোয়ার (৫৩)। অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়েন তিনি ও তার এক বন্ধু। সারোয়ারের মেয়ে ফাহিমা তানজীম সূচী বলেন, ঘটনার রাতে রহমতগঞ্জের বাসায় যাওয়ার আগে তার বাবা চুড়িহাট্টায় চায়ের দোকানে যান। ওই সময় সারোয়ারের সঙ্গে তার বন্ধু মাহবুবও ছিলেন। দগ্ধ মাহবুব এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। কিন্তু বাবাকে আর পাওয়া যায়নি।

চকবাজারের ব্যাগের দোকানদার জহিরুল হক সুমন। স্ত্রীর লাশের অপেক্ষায় প্রতিদিনই মর্গে মর্গে ঘুরছেন। তিনি বলেন, ঘটনার একটু আগে আমার স্ত্রী হাজি বাল্লু রোডের বাসা থেকে বের হয়ে আমাকে ফোন দেয়। আমিও তাকে আসতে বলি।  সাড়ে ১০টার দিকে তার মোবাইল ফোনে দুইবার কল দেই। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। এরপর থেকে তার মোবাইলটা বন্ধ। স্ত্রীর লাশের আশায় ডিএনএ নমুনাও দিয়েছেন তিনি যদি কোনো হদিস পাওয়া যায়। তাহলে অন্তত নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারতেন। পাঁচ বছরের শিশু সানিন শুধু মাকে দেখতে চাইছে। মাত্র ৫ মাস ২০ দিনের আরেকটি শিশুসন্তান আছে সুমন ও শিল্পী দম্পতির।

কেরানীগঞ্জের রাইতা আটির বাসিন্দা ও চকবাজারে স্টেশনারির দোকানদার এনামুল হকের লাশ পেতে ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন তার বাবা ও বোন জরিনা বেগম। জরিনা বলেন, ঘটনার দিন রাতে সে বাসায় ফিরতেছিল। সঙ্গে তার দোকানের এক কর্মচারী ছিল। সে কইছে, ভাই তারে রিকশা থিকা ধাক্কা দিছিল আগুন লাগার পর। তারপর কর্মচারী দৌড়াইল। তারপর থেকে ভাইয়ের খোঁজ না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ আর চকবাজার এলাকায় ছোটাছুটি করছেন জরিনা। তার একটা তিন বছরের বাচ্চা ছেলে আছে। বাচ্চাডা আব্বা আব্বা করতাছে। মদিনা গ্রুপের সিনিয়র ক্যাশ এক্সিকিউটিভ নাসরিন জাহান (৩২) ও তার স্বামী-সন্তানকে খুঁজছেন তাদের স্বজন-বন্ধুরা। ঘটনার দিন অফিস থেকে বেরিয়ে স্বামী আহাম্মদ লিপু ও ছেলে আবতাহীকে নিয়ে রাতের খাবার কিনেছিলেন নাসরিন, তারপর ফিরছিলেন বাসায়। ওই সময়ই পড়েন অগ্নিকাণ্ডে। তাদের তিনজনের খোঁজ এখনো মেলেনি।

চুড়িহাট্টার সবজি বিক্রেতা নূরুল হকের সন্ধানে হন্যে হয়ে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভাই আয়নাল হকসহ পরিবারের তিনজন। চুড়িহাট্টার প্লাস্টিক ব্যবসায়ী জাফরের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন তার দুই ছেলে। প্লাস্টিকের কারখানার মালিক আহসান উল্লাহর সন্ধান চান স্ত্রী বিবি কুলসুমসহ স্বজনরা। আগামসি লেনের বিবিএ’র ছাত্র তানজিল হাসানের খোঁজ চান তার বাবা মো. হাসান ও মা রুবিনা ইয়াসমিন। নারায়ণগঞ্জের দেলপাড়ার রিকশাচালক নূরুজ্জামান হাওলাদারের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন স্বজনরা। সোয়ারীঘাটের রিকশাচালক হেলালের জন্য এসেছেন দুই ভাই। চকবাজারের পণ্য সরবরাহকারী শাহিন আহমেদের খোঁজে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্ত্রী-সন্তানরা। ইব্রাহিমেরও সন্ধান চাইছেন স্ত্রী-সন্তানরা। ছেলে রফিক মিয়ার খোঁজে এসেছেন বাবা। নূরুল ইসলামের জন্য এসেছেন তার ছেলে। হাজী ইসমাইলের জন্য এসেছেন ছেলে। মোস্তফার সন্ধান চান বাবা-মা। রাজুর মা ও দুলাল কর্মকারের ছেলে তাদের খোঁজ করছেন।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-ফরেনসিক) রুমানা আক্তার বলেন, ‘চুড়িহাট্টায় নিহত ৬৭ মরদেহ থেকে ২৫৬ (রক্ত, টিস্যু, হাড় ও বাক্কাল সোয়াব) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি বিচ্ছিন্ন হাতকে পৃথক আলামত হিসেবে গণ্য করা হলে মোট সংগৃহীত নমুনার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৭। গত বুধবার পর্যন্ত ৪৯ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা রাখা হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads