• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিবাদের শিল্পকর্ম

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৩ মার্চ ২০১৯

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রেরণা ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। কালের নিরীক্ষায় যে ভাষণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক মর্যাদা। মূলত মহান মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা এবং স্বাধীনতার কৌশলী ঘোষণা ছিল সেই ভাষণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে সবার অংশগ্রহণের প্রেরণা ছিল এই ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে তেমন কোনো প্রচারণার মাধ্যম ছিল না। তখন বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাপে বারবার প্রচার করা হতো এই ভাষণটি। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই ভাষণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মানসিকভাবে চাঙা করে রাখত। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের আহ্বানে ও নির্দেশনায় বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা সবাই যে যেভাবে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সব পেশার মানুষ যে যার অবস্থান থেকে পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে গেছে মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে। শিল্পীরা গেয়েছেন গান, কবিরা লিখেছেন কবিতা, চিকিৎসক দিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা, চিত্রশিল্পীরা এঁকেছেন প্রতিবাদের পোস্টার। আমাদের চারুশিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, নিতুন কুণ্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, দেবদাস চক্রবর্তী রং-তুলির সঠিক ব্যবহার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পোস্টারে। তাদের তুলির আঁচড় ইয়াহিয়ার মসনদে কাঁপন ধরিয়েছিল। জানা যায়, সে সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রচার বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসান। তার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, জহির আহমদ প্রমুখ। সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে পোস্টার আঁকার কাজ করেন। এসব পোস্টারে জরুরি বার্তা বাণী ছাড়াও ছিল ক্যারিকেচার।

আমাদের শিল্পী, সাহিত্যিকরা সমন্বিত প্রচেষ্টায় তেজোদ্দীপ্ত পোস্টারে স্লোগান লিখে বাঙালির মুক্তির চেতনাকে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহানুভূতি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এসব পোস্টার। পাক হানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ নাড়া দিয়েছিল ভিনদেশি শিল্পীদেরও। এসব প্রেরণার পোস্টারের অসাধারণ অবদান রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে। মুক্তির চেতনায় দ্রোহের আগুনে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছড়িয়ে পোস্টারগুলো হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাদায়ক পোস্টারের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ : পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মানুষরূপী হায়েনা ইয়াহিয়া খানের বীভৎসতার প্রতি তীব্র ঘৃণার এই স্লোগান ফুটে ওঠে শিল্পী কামরুল হাসানের পোস্টারে।

‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ :  বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণের চিত্র তুলে ধরা হয় এ পোস্টারে। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’ : বাঙালির এক পরিচয়, এক চাওয়া, এক দাবির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ ফুটে ওঠে এই পোস্টারে। ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা’ :  মুক্তির লক্ষ্যে যুদ্ধের বাঙালি নারী ও পুরুষদের অংশগ্রহণের প্রেরণায় ছিল এই স্লোগান নির্ভর পোস্টারটি। ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’ : শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর এই পোস্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়, সংকল্প অনমনীয়তার চিত্রকল্প তুলে ধরা হয়েছিল। ‘জয় বাংলাদেশ জয় মুক্তিবাহিনী’ শিরোনামের একটি লিফলেটে বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির অদম্য স্পৃহাকে কিছুতেই নিভিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আমরা সবাই প্রয়োজন হলে জীবন দিতে প্রস্তুত। যতদিন পর্যন্ত না আমরা আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে।’ ‘আমাদের লক্ষ্য’ শিরোনামে অপর এক পোস্টারের বাঙালি নেতার বাণী তুলে ধরে বলা হয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সংকল্পবদ্ধ মানুষের কাছে অত্যাচারী শক্তি পরাজিত ও পরাভূত হতে বাধ্য। এসব পোস্টারই বলে দেয় মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত তেমন একটি পোস্টারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক নীতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। বেশকিছু পোস্টার পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে ধারণা দেয়।

১৯৭১-এর উত্তাল সময়ে মুক্তিকামী বাঙালিকে সাহস জোগাতে শিল্পীরা ক্যানভাস রাঙান প্রতিবাদী তুলিতে। রং-তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস রাঙিয়ে, সাত কোটি বাঙালির মাঝে স্বাধীনতার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শিল্পীরা। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, একাত্তর সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে জোরাল ভাষা ছিল লিফলেট পোস্টার। তখন ব্যক্তিগতভাবে বা বিভিন্ন সংঘ সমিতির উদ্যোগে এগুলো প্রকাশ করে প্রচার করা হতো। একাত্তর সালে এসব পোস্টার সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পোস্টার চলে যায় দেশের বাইরেও। কলকাতা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে, বাসের গায়ে ছিল বাঙালির প্রতিবাদের এসব ভাষা।

মুক্তিযুদ্ধের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সচিবালয়ের পাশে প্রথম হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে হাতে লেখা পোস্টারই চোখে পড়ে বেশি এবং এর ধারাবাহিকতা ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নারায়ণগঞ্জে এক পোস্টার আঁকাকে কেন্দ্র করে মুস্তাফা মনোয়ার জেল খেটেছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ইমদাদ হোসেনের আঁকা বেশকিছু পোস্টার জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭০-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ পোস্টারটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ও এ ধরনের পোস্টার দেখা গেছে। ’৬০-এর দশকের শুরুতে এক রংয়ের অফসেট মেশিনে পোস্টার ছাপা হয়। তৎকালীন যে প্রেসগুলো পোস্টার ছাপানোর কাজ করত এগুলো হলো পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রেস, রিগ্যাল প্রেস, আর্ট প্রেস প্রভৃতি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads