• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
আলোর পথে হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়

আজাদ হোসেন সুমন

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

আলোর পথে হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৭ মার্চ ২০১৯

বাংলাদেশে হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায় হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কে চায় পিছিয়ে থাকতে? সমাজে অবহেলিত বলে বিবেচিত হিজড়া ও বেদে জনগোষ্ঠী সময়ের তাগিদে নিজেদেরকে এক ধাপ উপরে তোলার নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা এখন সবার সহযোগিতা চায়। সরকারের পাশাপাশি সমাজের উঁচুস্তরের প্রতিনিধি এবং বিত্তবানদের সহায়তাও তাদের জন্য জরুরি।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, তাদের ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রক্ষার পাশাপাশি নতুন জীবিকা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান এই দুটি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করছেন। চির অবহেলিত এই দুই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তিনি যারপরনাই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ডিআইজি হাবিব ইতোমধ্যে সাভারের বেদে পল্লীর চেহারা বদলে দিয়েছেন। ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়ার পাশাপাশি বেদে সম্প্রদায়ের উপযুক্তদের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। হিজড়াদের সচ্ছল জীবিকার জন্য বিভিন্ন স্থানে খুলে দিয়েছেন বিউটি পার্লার। এরা এখন আর্থিকভাবে সক্ষম। কাজ করে উপার্জন করতে পারছে। নিজেদের জীবনযাত্রার মানকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।

হিজড়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের খবরের সঙ্গে কথা বলেন অনন্যা হিজড়া। তিনি বলেন, ‘একজন হাবিব স্যার বদলে দিয়েছেন আমাদের পরিচয়। আমরা এখন বিউটি পার্লার থেকে উপার্জন করতে শিখেছি। অন্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে তুলতে সচেষ্ট হচ্ছি। তিনি আরো বলেন, খুব বেশি নয় হাবিব স্যারের মতো ১০ জন মহানুভব লোক আমাদের দিকে সুদৃষ্টি দিলে বাংলাদেশের কোথাও আমাদের কোনো সমস্যা থাকবে না। এখন আমাদের প্রকট কোনো সমস্যা নেই। আছে শুধু দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আমরা তৃতীয় লিঙ্গের বলে আমাদেরকে সমাজে শুধু অবহেলা নয়, ঘৃণার পাত্র হিসেবে দেখা হয়। এটা আমাদের জন্য খুব দুঃখজনক। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে আমাদের অবস্থার তত ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হাবিব স্যারের সুদৃষ্টিই আমাদের আলোর পথে নিয়ে এসেছে।’

বদলে যাওয়া সাভারের বেদে পল্লী

আবহমানকাল ধরেই সমাজের প্রান্তে বাস করে আসছে বেদে সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। অথচ এই মানুষগুলোকে সমাজের প্রান্ত থেকে মূলে তুলতে কখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি কাউকে। দিন দিন অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে ডুবে ছিলেন সাভারের বেদেরা। সময় পাল্টে গেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনধারা। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের বেদে সম্প্রদায়ও। উন্নত হচ্ছে তাদের জীবনমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অন্ধকার জীবন থেকে আলোতে ফিরছে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী।

বর্তমান ডিআইজি ও তৎকালীন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের আন্তরিক প্রচেষ্টা এই সম্প্রদায়কে টেনে তুলেছে সমাজের মূল স্রোতে। এলাকার বেদে সম্প্রদায় সম্পর্কে জানা যায়, শত বছর আগে সাভারের পোড়াবাড়ী এলাকায় বসবাস শুরু করে বেদে সম্প্রদায়। সাভারের বংশাই নদীর তীরে এই পোড়াবাড়ীর অবস্থান। এখানে বসবাস বিভিন্ন গোত্রের প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার মানুষের। এদের মধ্যে কেউ সাপুড়ে এবং বাজিকর। এরা চুড়ি-ফিতা বিক্রি, সাপ খেলা ও জাদু দেখানো, সিংগা লাগানো এবং তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দিনে দিনে সামাজিক উন্নয়ন আর সচেতনতার ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের এই পদ্ধতিগুলো মানুষ বর্জন করতে থাকে। ফলে একরকম দুর্দশায় পড়েই নানারকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়ে। ঝাড়ফুঁক, সিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোক ফেলা, সাপ পালন ও বিক্রি এবং মাদক ব্যবসা যে এলাকার চিরচেনা রূপ ছিল, সেই বেদেপল্লীতে এখন দিন বদলের ছোঁয়া লেগেছে। থেমে গেছে নিজেদের মধ্যকার বিবাদ। বন্ধ হয়েছে বহুবিবাহ। জীবনমান বদলে যাওয়ায় ওই এলাকায় ঘরে ঘরে এখন কর্মক্ষম মানুষ। এক সময়ের অলস মানুষগুলো এখন কর্মব্যস্ত জীবন পার করছে।

নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও ইতিহাস

নৃতাত্ত্বিক বিবেচনায় কিন্তু বেদেরা অনার্য। তাদের মধ্যে আরবদের সেমিটিক কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। বেদেরা সুঠাম দেহ, গভীর কালো গায়ের রঙ, কোঁকড়ানো চুল, আয়ত ও কালো চোখের অধিকারী। শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তারা আদি অস্ট্রাল বংশোদ্ভূত। তাদের এদেশে আসা নিয়ে অবশ্য অনেক ধরনের তত্ত্ব প্রচলিত আছে। কারো মতে, তারা আরাকানের মনতং মান্তা নৃগোত্র থেকে এসেছে। কেউ বলে থাকেন, বেদেরা সাঁওতালদের বিচ্ছিন্ন অংশ। যারা পারস্যের সাথে বেদেদের সম্পর্ক খোঁজেন, তাদের মতে, বেদেরা সাত শতকে আরবের আলবাদিয়া নামক স্থান থেকে এদিকে এসেছে। অনেকের ধারণা, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে পূর্ব ভারত থেকে বেদেরা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং কালক্রমে এ অঞ্চলে আসে। বেদেরা কোনো এক সময় সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতিকূলতার জন্যই ঘরবাড়ির মায়া ছেড়ে বাধ্য হয় যাযাবর জীবন বেছে নিতে। শত শত বছর ধরে নদীর জীবনে অভিযোজিত হয়ে আজো তারা টিকে আছে এই ভূমিতে।

এরা এখন আশায় বুক বেঁধেছে, যদি আরো সহযোগিতা আসে, যদি উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠন বা হূদয়বানরা আরো এগিয়ে আসেন। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। তাহলে সেদিন আর হয়তো বেশি দূরে নেই, যেদিন এরাও অবহেলার পাত্র হয়ে নয়, মানুষের মতো মানুষ হয়ে বুক উঁচিয়ে চলতে পারবে, বাঁচতে পারবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads