• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
‘দুই জায়গায় দুই রকম চিকিৎসা’

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

চিকিৎসাসেবা

‘দুই জায়গায় দুই রকম চিকিৎসা’

  • লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২০ মার্চ ২০১৯

রোগী একই, রোগ একই, চিকিৎসকও একই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল ব্যবস্থাপত্র। একই রোগের চিকিৎসায় এবার ছয়টি ওষুধ সেবনের পরামর্শ পেলেন খুরশিদা বেগম।

খুরশিদা বেগম লক্ষ্মীপুর উপজেলার বাসিন্দা। পেটে ব্যথা, বদহজমসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তিনি। স্থানীয় একজনের পরামর্শে যান লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে। তিন ঘণ্টার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দেখা পান। আর ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) একটি ওষুধ দিয়ে বিদায় করেন। খুরশিদার মনে সংশয়। চিকিৎসা ঠিকমতো হয়েছে তো? পরে যে চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্র দেন, সেই চিকিৎসকের কাছেই তিনি যান একটি বেসরকারি ক্লিনিকে।

এরপর পড়লেন বিভ্রান্তিতে। কোন ব্যবস্থাপত্র সঠিক? যদি পরেরটা সঠিক হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক কেন একটি ওষুধ দিয়ে বিদায় করলেন? তিনি কি চিকিৎসা করতে চাননি? আর যদি আগেরটা সঠিক হয়, তাহলে বেসরকারি ক্লিনিকে এতগুলো ওষুধ দেওয়ার অর্থ কী? কেন তিনি দিয়েছেন। খুরশিদার এই ব্যবস্থাপত্রটি বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়ার মতো কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটি চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্র কি না, তা নিয়েও কথা তুলেছেন অনেকে। চিকিৎসা প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, এই ঘটনাটি সত্য হলে খুব অন্যায় হয়েছে। একজন চিকিৎসক সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালে আলাদা ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন না।

সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা যে সুবিধা পান অন্য পেশাজীবীরা তা পান না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখতে পারেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, জনগণের করের টাকায় বেতন নিয়েও সিংহভাগ চিকিৎসক কাজে ফাঁকি দেন। তাদের অনেকেই ঠিকমতো কর্মস্থলে আসেন না। আর যারা আসেন তাদের মধ্যে কয়জন মনোযোগ দিয়ে রোগী দেখেন, সেটি নিয়েও আছে প্রশ্ন। লক্ষ্মীপুরের ঘটনাটি তারই একটি প্রমাণ। আবার বেসরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থাপত্র লেখার সময় রোগ পরীক্ষার যে পরামর্শ দেওয়া হয় তা থেকে কমিশন আদায়ের অভিযোগও আছে। খোদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত বলেছেন, এই কমিশন খাওয়া বন্ধ হলে চিকিৎসার ব্যয় কমে যাবে ৩০ শতাংশ।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলাধীন ৬ নম্বর বাংগাখাঁ ইউনিয়নের খুরশিদা বেগম পেট ব্যথা, বদহজমের সমস্যা নিয়ে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে গিয়েছিলেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ সালাউদ্দিন শরীফের কাছে। তার রোগের কথা শুনে তাকে ইমেপ ২০ মিগ্রা নামের একটি ওষুধ লিখে দেন। কিন্তু এই চিকিৎসা পছন্দ হয়নি খুরশিদার। ভাবেন, ডাক্তার তাকে দেখে টাকা পাননি বলে হয়তো ভালোভাবে চিকিৎসা করেননি। তাই মনস্থির করেন তার ব্যক্তিগত চেম্বারে যাবেন। পরদিন এই সালাউদ্দিনের চেম্বারে গিয়ে ৭০০ টাকা পরামর্শ ফি দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। এই যাত্রায় সেবনের জন্য দেওয়া হয় ছয়টি ওষুধ। সেই সঙ্গে কয়েকটি পরীক্ষার নামও লিখে দেন।

বিষয়টি দেখে অবাক হয়ে যান খুরশিদা। তারই এক আত্মীয় বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেন। খুরশিদা এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘দুই জায়গায় দুই রকম চিকিৎসা। আমি আসলে কেমনে বুঝব কোনটা সঠিক চিকিৎসা? ওই সরকারি হাসপাতালে যদি চিকিৎসাই না থাকে তবে সরকার এদের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষের কী উপকারে আসছে।’ অভিযোগ আছে, এমন চিকিৎসকরা হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা না করে রোগীদের তার চেম্বারে যেতে বলেন।

তবে সালাউদ্দিন শরীফ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকারি নিয়মনীতি মেনে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। নির্ধারিত সময়ের পর প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। কোনো অন্যায় তিনি করেননি। রোগীর প্রশ্ন- তাহলে একই রোগী, একই রোগে ব্যবস্থাপত্র কীভাবে ভিন্ন হলো, সে প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না এই চিকিৎসকের কাছে। রোগীরা জানান, এটি লক্ষ্মীপুর হাসপাতালের কোনো একক চিকিৎসকের সমস্যা নয়। সামগ্রিক চিত্রই এমন। আরো বেশ কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, যারা হাসপাতালে যেনতেন চিকিৎসা দিলেও ব্যক্তিগত চেম্বারে গেলে ঠিকই অন্যরকম চিকিৎসা দেন।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা সিভিল সার্জন মোস্তফা খালেদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো ডাক্তার যদি সরকারি নিয়মনীতি না মেনে চলেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটা যদি তিনি (সালাউদ্দিন) করে থাকেন আমি বলব ঠিক করেননি। ডাক্তার হিসেবে তার উচিত বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে একই কায়দায় গুরুত্বসহকারে রোগী দেখা। এটা তার ঠিক হয়নি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক সুদীপ রঞ্জন দেব বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে যেসব ওষুধের সাপ্লাই (সরবরাহ) নেই, অনেক সময় চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে লেখেন না। আর লিখলেও বলে দেন এটা বাইরে থেকে কিনতে হবে। তবে লক্ষ্মীপুরের বিষয়টি কী হয়েছে তা আমি প্রেসক্রিপশন না দেখে বলতে পারব না।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads