• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
শান্তি কতদূর?

পাহাড়ে হত্যাকাণ্ড

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

পাহাড়ে হত্যা যেন নৈমিত্তিক ঘটনা

শান্তি কতদূর?

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ২২ মার্চ ২০১৯

কয়েক যুগের সশস্ত্র সংগ্রামে লাশের পাহাড় ডিঙিয়ে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হলেও এখনো শান্তি আসেনি পাহাড়ে। চুক্তি পরবর্তী সময়ে সাংগঠনিক ও আদর্শগত বিভক্তিতে কয়েকটি দলে পৃথক হয়ে আধিপত্যের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো। এ লড়াই কখনো ক্ষোভে-বিক্ষোভে, আবার কখনো সশস্ত্র তৎপরতায়। যে কারণে আদর্শগত দ্বন্দ্বে কিছুদিন পর পর রক্তে রঞ্জিত হয় পাহাড়ের মাটি। লাশের মিছিল আর স্বজনের বেদনায় বার বার ভারী হয় নির্মল প্রকৃতির নৈসর্গিক পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশে বহুমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থায়ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রায়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সশস্ত্র আঞ্চলিক দলের চাঁদাবাজি আর আধিপত্যের লড়াইয়ে বলি হতে হয় সাধারণ মানুষকে।

বছরের পর বছর ধরে একের পর এক সংঘটিত হয় অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড। এখানকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত-দিশেহারা। সেনা- পুলিশের যৌথ অভিযানেও নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না সশস্ত্র এসব সন্ত্রাসীদের।

গত ২২ বছরে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় পাহাড়ে খুন হয়েছেন ৭৩১ জন। গত ১৮ মার্চ ৭ জন নিহত হওয়ায় এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩৮-এ। চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশ দফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। পুলিশ সূত্র জানায়, ১৮ মার্চ সেভেন মার্ডারের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হামলাকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে হামলায় অংশ নেওয়া সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে চলে গেছে।

এদিকে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিভিন্ন সংগঠন আল্টিমেটাম দিয়েছে, সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা না হলে তারা কঠোর কর্মসূচি পালন করবে।

সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পরের বছর ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন জেএসএসের (জনসংহতি সমিতি) সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি প্রসীত খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ নামে নতুন সংগঠন গঠন হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন  জেএসএসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এলাকার আধিপত্য নিতে গিয়ে লিপ্ত হয় সংঘর্ষে। এতে উভয়পক্ষের সাড়ে ছয়শর বেশি নেতাকর্মী মারা যান। দুই গ্রুপের বলি হন আরো শতাধিক নিরীহ ও সাধারণ মানুষ।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থা চলাকালে ২০১০ সালে মূল জেএসএস থেকে সরে গিয়ে সুধাসিন্ধু খীসা, তাতিন্দ্রলাল ওরফে পেলে, শক্তিমান, অংশুমান চাকমাদের  নেতৃত্বে গঠন হয় জেএসএস এমএন লারমা নামে নতুন দল। ইউপিডিএফের পাশাপাশি আরেকটি দল জন্ম নিলে পাহাড়ে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটে। শুরু হয় ত্রিমুখী দ্বন্ধ। একে অপরের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি সশস্ত্র হামলা। যার ফলে পাহাড়ের কোনো না কোনো স্থানে প্রায় ঘটে রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা।

২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ১৮ মাইল এলাকায় ইউপিডিএফ সমর্থক অনাদী রঞ্জন চাকমাকে হত্যা করা হয়। পরে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ নেতা মিঠুন চাকমা, রাঙামাটির অনল বিকাশ চাকমাকে হত্যা করা হয়। অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন হিল উইমেনস ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙামাটি সাধারণ সম্পাদক দয়াসোনা চাকমাকে। এ অপহূতদের গত ২০ এপ্রিল মুক্তি দেওয়া হয়।

সবশেষ ২০১৮ সালের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস এমএন লারমা দলের সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার পথে রাঙামাটির বেতছড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীরা গাড়ি লক্ষ করে গুলি করলে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের সভাপতি তপনজ্যোতি চাকমাসহ মারা যান পাঁচজন। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হয়। কিছুদিন পর সশস্ত্র হামলায় খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় সাতজনকে। এরপর রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পানছড়িতে হত্যা করা হয় তিনজনকে।

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ৭ নির্বাচনকর্মীকে। এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত ১৪ জনকে চট্টগ্রাম সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। পরদিন হত্যা করা হয় বাঘাইছড়ি উপজেলা আ.লীগের সভাপতিকে। পাহাড়ে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন রোগীদের সম্পর্কে সিএমএইচের পদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ‘আহতদের অবস্থা উন্নতির দিকে। যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন তাদের অবস্থারও অনেকটা উন্নতি হয়েছে। পুলিশের একজন নারী সাব ইন্সপেক্টর মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অল্পের জন্য তিনিও প্রাণে বেঁচে গেছেন। ওই ঘটনায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ একে অপরকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পাহাড়ে হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এ কারণে চুক্তি-পরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলোর একটিরও বিচার হয়নি। ফলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যার ফলে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিচ্ছে তারা। বাঘাইছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ এসএম মঞ্জুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, হামলা পরিকল্পিত এবং রাতের অন্ধকারকেই ওরা বেছে নিয়েছে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘাতকরা বাঘাইছড়ির দুর্গম সাজেক সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। হামলায় বিদেশি ভারী অস্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। ৭ খুনের ঘটনায় ৪০-৫০ জনকে আসামি করে গত বুধবার রাতে বাঘাইছড়ি থানায় মামলা করেছে পুলিশ। তিনি আরো বলেন, আসামিদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads