• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
সড়কে যমের ভূমিকায় যানবাহন

ঘাতক বাস কেড়ে নিলো পথচারীর প্রাণ। থামছেই না মৃত্যুর মিছিল

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

সড়কে যমের ভূমিকায় যানবাহন

# লোভে অন্ধ মালিক-চালক # একের পর এক ঝরছে তাজা প্রাণ # জেলায় চালক প্রশিক্ষণ একাডেমির তাগিদ

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০১৯

সড়কে প্রতিদিন পথচারীদের সামনে যমদূত হয়ে দেখা দিচ্ছে বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক পরিবহন। ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে এসবের চালকরা। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও, কারো না কারো প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সমস্যাটি দিন দিন প্রকট হলেও সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে সরকারকে। তাদের মতে, পরিবহন সেক্টরে থাকা মালিক ও শ্রমিক পরিবহন সমিতি নামধারী মাফিয়াদের লাগাম টেনে ধরা না গেলে এ সমস্যার আশু কোনো সমাধান নেই। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়াটা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ ব্যাপারে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, অদক্ষ চালক দিয়ে যাত্রীবাহী দূরপাল্লার ভারী যানবাহন চালানো হচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। তার মতে, দেশের প্রতিটি জেলা শহরে চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ একাডেমি করা জরুরি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকরা গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে। এছাড়া চালকদের ডোপ টেস্ট নিশ্চিত করতে হবে। অধিকাংশ চালক ড্রাইভিং সিটে বসার আগে মাদক গ্রহণ করে। এতে দিশাহারা হয়ে চালকরা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। তিনি বলেন, চুক্তিভিত্তিতে চালকদের গাড়ি দেওয়ায় তারা রাস্তায় যাত্রী তোলার ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। আর এ প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। সবকিছু একটা সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। রাজধানীর সড়কে প্রচুর পরিমাণ বাস ‘বে’ তৈরি করতে হবে। নির্দিষ্ট বাস ‘বে’ থেকে তারা নিরাপদে যাত্রী তুলতে পারবে। নিয়ম করতে হবে— যত্রতত্র গাড়ি থামানো যাবে না। রাস্তার মাঝপথে যে গাড়ি যাত্রী তুলবে সে গাড়ি, গাড়ির চালক ও মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আরো ‘অনেক ব্যাপার’ আছে পরিবহন সেক্টরে। তাই এ সেক্টর নিয়ে আর হেলাফেলা উচিত নয় বলেও মনে করেন পুলিশের এই শীর্ষ কর্মকর্তা। তার মতে, দুর্ঘটনারোধ ও সড়ককে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অগ্রসর হতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ দুর্ঘটনার জন্য শুধু যাবাহন বা চালকরাই দায়ী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পথচারীরা চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে। এতেও সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। এখনো শতকরা ৫০ জনেরও বেশি মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না বা বোঝে না। তারা যত্রতত্র ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে। তাই শুধু চালকদের সচেতন করেই কি সড়কপথে দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব নয়।

দুর্ঘটনার পেছনে মালিকদের দায়িত্বহীনতা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে চালকদের। ঢাকা-গাজীপুর রুটের বলাকা পরিবহনের একজন বাসচালক রাশেদ মৃধা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সব স্তরেই সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। আমি প্রায় ৭ বছর ধরে বাস চালাই। অনেক সময় মালিকরা বেশি লাভের জন্য অল্প টাকায় কম বয়সি ছেলেদের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেয়। তাদের অনেকেই গাঁজা খেয়েও গাড়ি চালায়। তাই শুধু চালক বা শ্রমিক নয়, মালিকদেরও সচেতনতা দরকার। তিনি আরো বলেন, এছাড়া গাড়ি চালানোর সময় অনেক শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্করাও চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড় দেয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ইদানীং তো সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনারোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। চালকদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো আইন করতে গেলে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে পরিবহন শ্রমিক-মালিক একজোট হয়ে যায়। তারা সমস্ত যান চলাচল বন্ধ করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ ও সরকার তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তিনি আরো বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে সচেতনতা ও আইন দুটোরই প্রয়োজন।

তিনি বলেন, মালিকরা অতিরিক্ত আয় এবং ব্যাংকঋণ দ্রুত পরিশোধ করার তাড়নায় চালকদের ওপর চাপ দেয়। ফলে চালকরাও অতিরিক্ত বেতনের আশায় চাপ নিয়ে গাড়ি চালায়। তখনই যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়।

পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্লাহ বলেন, চালকদের বেশি অর্থের জন্য চাপ দেন এমন মালিক সংখ্যায় কম। এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি বলেন, চালকদের যেমন দোষত্রুটি আছে তেমনি চলাচলের ক্ষেত্রে জনসাধারণেরও সচেতনতার ঘাটতি আছে। সচেতনতা যদি না বাড়ে তাহলে তাহলে শুধু আইন দিয়ে কোনো লাভ হবে না। ৫৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে পথচারীদের কারণে। তাই সচেতনতা ও আইন দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা আরো বলেছেন, পরিবহন সেক্টরে সরকারকে আরো বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নিতে হবে মহাপরিকল্পনা। পাশাপাশি পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে। শ্রমিক, মালিক, বিআরটিএ, সরকারের প্রতিনিধি, বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘হাইপ্রোফাইল’ জাতীয় কমিটি গঠন করে সড়কে নৈরাজ্য নিরসনে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। যদি সেটা সম্ভব হলেই কেবল সড়ক দুর্ঘটনা রোধ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads