• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

যমুনার বুকে ধূ-ধূ বালুচর

  • সোহেল রানা, সিরাজগঞ্জ
  • প্রকাশিত ২৪ এপ্রিল ২০১৯

বর্ষা মৌসুমের করালগ্রাসী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণকারী যমুনা বর্তমানে নাব্য হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই যমুনার বুকে কচ্ছপের পিঠের মতো অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠেছে। চরের ফাঁকে ছোট ছোট চ্যানেলগুলো মানুষ হেঁটে হেঁটে পার হচ্ছে। এই অবস্থা চরাঞ্চলবাসীর জন্য একদিকে যেমন সুখের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে, তেমনি জেলেদের জন্য নিয়ে এসেছে চরম দুঃখের বার্তা। জেলার পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর বুকে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় যমুনা তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ক্রমেই নদীটি পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ ও পূর্ব তীরে অবস্থিত টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-তারাকান্দি-চৌহালী উপজেলার দিকে ঢুকে পড়ছে। গ্রাস করছে বসতভিটা-ফসলি জমি, নিঃস্ব করে ফেলছে চর এলাকার হাজার হাজার পরিবারকে। যা দু’পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনিসংকেত। এছাড়া বেলকুচি-শাহজাদপুরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক হুরাসাগরটিও মরাখালে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিলুপ্তির পথে মৎস্যসম্পদ। একসময় যমুনা ও চলনবিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রফতানি হতো। অবিলম্বে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পুনঃখনন করা না হলে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে নদীগুলো।

জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, সলঙ্গা, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও নওগাঁর আত্রাই নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল গঠিত। গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮ বর্গ কি.মি.। চলনবিলে ছোট-বড় প্রায় ৪০টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল ছিল। কালের বিবর্তনে ২৪টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। খালগুলোর অস্তিত্ব নেই। চলনবিলের পানির স্রোতধারা ও নাব্য হারিয়ে ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে বিলের আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে মূল বিলটির আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১ কি.মি.। এছাড়া বিলের গভীরতা থাকে ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছরজুড়ে ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে সারা বছরই নৌ চলাচল করত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব এবং গত শতাব্দীর আশির দশকে পদ্মার উৎসমুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলো পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে। চলতি দশকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরো বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ফলে বিলের দেশীয় প্রজাতির প্রায় ৫০ প্রকার মাছের অধিকাংশই বিলুপ্তি ঘটেছে। বিলুপ্ত প্রায় এসব মাছের মধ্যে রয়েছে কই, শিং, মাগুর, কাঁকিলা, শোল, বোয়াল, চিতল, মোয়া, হিজল, তমাল, জারুল বাতাসি, টেংরা, গোলসা, নন্দই, পুটি, সরপুঁটি, খলিশা, চেলা, ডানকানা, টাকি, বাইটকা, বাউস, কালোবাউস, চ্যাকা, বাইম, বউমাছ, গোঁচৌ, গোরপুইয়া, কুচিয়া, কচ্ছপ, কাছিম ও কাঁকড়া ইত্যাদি।

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সমন্বয়ক মিজানুর রহমান জানান, যতদিন যাচ্ছে ততই চলনবিল ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। চলনবিলকে রক্ষায় সরকারের কাছে ২৬ দফা দাবি দেওয়া হয়েছে। সরকার শুধু আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকা রাখছে না। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের সহ-সভাপতি সাংবাদিক দীপক কুমার কর জানান, যে নদীকে ঘিরেই মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, গড়ে উঠেছিল বন্দরসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথচ সেসব নদীই এখন মৃতপ্রায়। নদী মরে যাওয়ার কারণে মানুষ ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। নদী রক্ষা করতে যমুনা ও পদ্মা নদীসহ বিলের প্রধান প্রধান নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। দখল বন্ধ ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশালী শফিকুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জের উত্তরে কাজিপুর থেকে দক্ষিণে চৌহালী পর্যন্ত প্রায় ৮২ কি.মি. দৈর্ঘ্য যমুনা নদীর। পূর্বে টাঙ্গাইল, পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনার প্রস্থ প্রায় ১৫ কি.মি.। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে লাখ লাখ টন পলি পড়ে। এ জন্য স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে যমুনার বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। ফলে নদীটি আঁকাবাঁকা ও বিভিন্ন চ্যানেল বিভক্তি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বড় দুটি চ্যানেল পূর্ব-পশ্চিম তীর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীর এলাকাগুলো ভাঙনের মুখে পড়ছে। সরকার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবায়ন হলে নদী আগের যৌবন ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি তীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নদীগুলোও খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে করতোয়া, ফুলজোড়, হুরাসাগর ও বাঙ্গাল নদীর ১২২ কি.মি. খননের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি বছর দরপত্র আহ্বান করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads