• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
‘কেন ধান আবাদ করব’

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

‘কেন ধান আবাদ করব’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৪ মে ২০১৯

সারা দেশে বোরো ধান কাটার ধুম উৎসব চলছে। এ সময় কৃষকের আনন্দ হওয়ার কথা। কিছুটা হচ্ছেও। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটাচ্ছে কাটার খরচ। ধান বিক্রি করে এ খরচ উঠছে না। স্বভাবতই ধান চাষে আগামীতে অনাগ্রহের কথা জানান কৃষকরা। ধানের বদলে তামাক বা ভুট্টার মতো ফসল চাষে আগ্রহের কথা জানান তারা।

এর মাঝে মজার কিংবা কষ্টের বা অভিনব প্রতিবাদ করেছেন টাঙ্গাইলের এক কৃষক। তিনি নিজের লাগানো ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ধান কাটতে মজুরির পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, ধান বিক্রি করে মিলছে তার অর্ধেক। পাওয়া যাচ্ছে না দিনমজুরও। ফলে ধান পেকে মাঠেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার দুপুরে জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের আবদুল মালেক সিকদার তার চাষ করা জমির ধানে আগুন ধরিয়ে দেন। তিনি বলেন, সরকার মণপ্রতি ধান ৫০০ টাকা করে ধরেছে। ধান কাটতে দিনমজুরকে দিতে হচ্ছে প্রায় এক হাজার টাকা মণপ্রতি। এরপরও ধান ঘরে তুলতে আরো খরচ আছে। তিনি আরো বলেন, বেশি মজুরি হলেও দিনমজুর পাওয়া যায় না। খেতে ধান পাকলেও তা ঘরে তুলতে পারছি না। তাই এক দাগের ৫৬ শতাংশ ধানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছি।

অন্যদিকে টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, এ বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। এ জেলায় দিনপ্রতি একজন দিনমজুরকে দিতে হয় ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। আর বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য ৫০০ টাকা মণ। এতে প্রায় দুই মণ ধান বিক্রি করে কৃষক একজন দিনমজুরের মজুরি দিতে হচ্ছে। আবার অধিক মজুরি দিয়েও দিনমজুর পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে জমিতে পাকা ধান জমিতে পড়েই নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা থানার ভেলাগুড়ি ইউনিয়নের কৃষক আবদুল খালেক বলেন, এক দোন (২৭ শতাংশ) জমির ধান কাটতে চুক্তিতে পরিশোধ করতে হয়েছে ২ হাজার টাকা। সেই এক দোন জমির ধান বাড়িতে আনতে ভ্যান খরচ দিতে হয়েছে ৪০০ টাকা এবং মাড়াই করতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০০ টাকা। এর আগে নিড়ানি দিতে খরচ হয়েছে দোনপ্রতি ৪০০ টাকা। ধান লাগাতে দিতে হয়েছে দোনপ্রতি ১ হাজার ২০০ টাকা, সেচ বাবদ দোনপ্রতি ১ হাজার ৬০০ টাকা, সার বাবদ দোনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা, বীজ বাবদ ৪০০ টাকা এবং চাষ বাবদ ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। এক দোন জমির ধান আবাদ করতে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। বিপরীতে এক দোন জমিতে ধান পাওয়া যায় ১৪ থেকে ১৫ মণ। আবদুল খালেক বলেন, বর্তমান বাজারে ধানের দাম সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে ধানের দাম আসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। ৯ হাজার টাকা খরচ হলে দোন করা তিন মণ ধান বা ১ হাজার ৫০০ টাকা লোকসান হচ্ছে কৃষকের। এই কৃষক বলেন, গতবার এই সময় ধানের দাম ছিল ৯০০ টাকা মণ। অথচ এক বছরের ব্যবধানে সেই দাম তো বাড়েইনি, উল্টো কমে দাঁড়িয়েছে ৫০০ টাকায়। অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় ধান কাটার মজুরিও বেড়েছে।

আবেগতাড়িত হয়ে আবদুল খালেক বলেন, এভাবে লস করে কার জন্য, কেন ধান আবাদ করব? প্রতি দোন জমিতে তিন মণ ধান লস করছি। নিজের শ্রমের দাম তো বাদই দিলাম না হয়। তাই সামনে আর ধান আবাদ করব না। পরিবর্তে তামাক আবাদ করব। তামাক আবাদে অনেক বেশি লাভ। নিজের জন্য এক দোন জমি আবাদ করলেই ছয় মাসের ভাত হয়ে যাবে। বাকি ছয় মাস তো আমন ধানে চলে। তবু অন্যের জন্য আর ধান আবাদ করব না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি বাজারে ১২-১৩ টাকা কেজিতে ধান বেচাকেনা হলেও একই বাজারে চালের দাম ৩২ টাকা। আর এই চাল রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা।

একই ধরনের অবস্থায় পড়েছেন নাটোরের চলনবিল এলাকার কৃষকরা। চলনবিল মানেই মাছ আর ধানে ভরপুর। বর্ষায় পাবিতে ডুবে থাকে বিল, সে সময় চলনবিলের মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পানি শুকিয়ে গেলে পলি পড়া জমিতে কৃষকরা ধান চাষ করেন। বৈশাখের শুরু থেকেই চলনবিলের ধান কাটা শুরু হয়। সাধারণত এই সময়ে কৃষকের পরিবারের মানুষগুলোর দম ফেলার সময় থাকে না।

তবে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার শ্রীপুর এলাকার কৃষক সাইদুর রহমান বলেন, ধান লাগানো থেকে শুরু করে কেটে মাড়াই করে ঘরে তোলা পর্যন্ত যে টাকা খরচ হচ্ছে, তাতে দান আবাদ করে পোষাচ্ছে না। তাই গত বছর ২০০ বিঘায় ধান লাগানো হলেও এবার ১০০ বিঘা ধান লাগিয়েছিলেন তিনি। এ বছর ধানের দাম না বাড়লে আগামী বছর আবাদের পরিমাণ আরো কমিয়ে আনবেন। পরিবর্তে ভুট্টা লাগাবেন। জানালেন, দিনমজুর না পাওয়ায় অনেক জমির ধান এখনো কাটা হয়নি।

যদিও লালমনিরহাটের তুলনায় চলনবিলে ধান আবাদ করতে খরচ কিছুটা কম পড়ে। কারণ পলির আবরণ পড়ায় এই জমিতে ধান চাষে সার তেমন লাগে না, আবার ফলনও বেশি হয়। তারপরেও যথাযথ বাজার মূল্য না পেয়ে ধান আবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন চলনবিল-কেন্দ্রিক কৃষকরা।

সামগ্রিক বিষয়ে বগুড়ার ধুনট থানার চরপাড়া গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ জানান, বর্তমানে এক মণ ধানের দাম (ভেজা) ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। আর একজন কামলার মজুরি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। এই মজুরিতে কামলা নিয়ে ধান কাটলে কৃষককে ধান চাষে মোটা অঙ্কের লোকসান দিতে হবে। তিনি বলেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এক সময় কৃষক আর ধান চাষ করবে না।

আকিমুদ্দিন শেখ নিজেই প্রশ্ন করেন, কৃষক কী করবে? ধান, পাট, সবজি কোনো ফসলেরই দাম পাচ্ছে না তারা। কৃষক আজ ধান চাষ করে বিপদে পড়েছে। পাট চাষ করলে পাটের আঁশ ছাড়ানোর সময় কামলার যে মজুরি পড়ে তাতেও পোষায় না। সবজি, কপি, টমেটো করলে এমন দাম হয়, এক সময় সেগুলো গরুকে খাওয়াতে হয়। এ অবস্থায় কৃষক এখন কী করবে?

বাংলাদেশের খবরের নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁয় বোরো ধানকাটা শুরু হয়েছে। ফণীর আগে এখানে একজন কামলার মজুরি ছিল ৪০০-৫০০ টাকা। ফণীর প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ায় অধিকাংশ জমির ধান পানিতে পড়ে গেছে। ফলে পানির মধ্যে পড়া ধান কাটতে এখন কামলার মজুরি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। অথচ এক মণ ধান বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এ অবস্থায় কৃষকরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এদিকে পানিতে পড়ে যাওয়া ধান দ্রুত না কাটলে এবং এভাবে পানিতে পড়ে থাকলে এই ধান থেকেই গাছ বের হয়ে যাবে। ফলে কৃষক আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে কারণে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত মজুরিতে কামলা নিয়ে ধান কাটছে কৃষক।

আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলায় এখনো বোরো ধান কাটা শুরু হয়নি। তবে ১০-১২ দিনের মধ্যে ধান কাটা শুরু হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এখানে পুরাতন ধান (মোটা) বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৫৫০ টাকা। দিনাজপুরে ধান কাটা শুরু হলেও এক মণ ধান বিক্রি করে একজন কামলার মজুরি হবে না। অতীতেও এমনটা দেখা গেছে। এলাকার দিনমজুররা এখন বগুড়া, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জে ধান কাটছে। জানা গেছে, সেখানে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরিতে তারা ধান কাটছে।

খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ শেখ মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, কৃষি উৎপাদনে ব্যয় কমাতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার ইচ্ছে করলেই ফসলের দাম বাড়াতে পারবে না। সরকার যে চাল ক্রয় করে তাতেও কৃষক খুব বেশি লাভবান হয় না। ফসলে লাভ করতে হলে কৃষককে যান্ত্রিকীকরণে আসতে হবে। তাছাড়া কৃষক লাভবান হতে পারবে না। তিনি বলেন, যান্ত্রিকীকরণে আসতে একটু সময় লাগবে, তবে আমাদের কৃষকরাও একদিন যন্ত্রনির্ভর হবে এবং ফসলে লাভ করতে পারবে। আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি দিচ্ছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads